রাজতরঙ্গিনী দ্বিতীয় তরঙ্গ
রাজতরঙ্গিনী দ্বিতীয় তরঙ্গ
দেবশ্রী চক্রবর্তী
ইতিহাস ও মহাকাব্যের এক মিলিত অমূল্য দলিল রাজতরঙ্গিনী, যেখানে উঠে এসেছে কাশ্মীরের তৎকালীন সমাজ , রাজনীতি তথা অর্থনৈতিক জীবনের জীবন্ত চিত্র । শান্তরস প্রধান এই রচনায় খাঁটি ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচার বুদ্ধি ও বাস্তব জ্ঞান এর পরিচয় মেলে । দ্বিতীয় তরঙ্গে আমরা যে সমস্ত শাসকের সম্বন্ধে পড়লাম তাঁরা হলেন প্রতাপাদিত্য, জলউক , তুঞ্জির বিজয়, জয়েন্দ্র , স্নধিমান প্রমুখ । এদের মধ্যে প্রতাপাদিত্য ও জলৌকা সুষ্ঠ ভাবে দেশ শাসন করেছিলেন এবং এদের সময় কাশ্মীরের শ্রী বৃদ্ধি হয়েছিল ।
কেউ কেউ এই বিক্রমাদিত্যকে শকারি বিক্রমাদিত্য হিসাবে ভেবে ভ্রমে পড়ে গেছেন এবং ভ্রমাত্বক বিবরণ লিখেছেন । বিক্রমাদিত্য বত্রিশ বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যু হলে জালউকা রাজা হয়েছিলেন । এনারা উভয়ই সুশাসক ছিলেন । তবে আমার মনে হয় এই তরঙ্গে যে সব রাজাদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তুঞ্জীর ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাজা । সুখের দিনে তো বটেই কিন্তু দুঃখের দিনেও কিভাবে জনগণের পাশে দাঁড়ান যায় , সাহায্যের হাত কতদূর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে দুঃখী প্রজাদের দিকে এগিয়ে দেওয়া যায় তাঁর জ্বলন্ত নিদর্শন মহারাজ তুঞ্জীন । ইনি কাশ্মীরের ইতিহাসে জাগ্রত পুরুষ হিসাবে দেবতার আসন দখল করেছেন এবং থাকবেন ।
শৈলনগরী কাশ্মীরে হিম বৃষ্টি নতুন কিছু না । কিন্তু তুঞ্জীনের আমলে শরতের পাকাধান ঘরে তোলার আগেই শুরু হয় হিম বৃষ্টি । যার পরিণাম হিসাবে দেশ জুড়ে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, হাহাকার । পারিবারিক জীবন বিপণয় হয়ে ওঠে । পিতা খাদ্য পেলে পুত্রকে না দিয়ে খেত, পুত্র খাদ্য না পেলে পিটাকে দিয়ে খেত । প্রজাদের দুঃখ দেখে, তাঁদের অন্ন সরবরাহ করতে নাপেরে শাসক যখন নিজের জীবন ত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেন তখনি তাঁর মহত্ব প্রকাশ পায় । মনের রাখার বিষয় হল, দুর্ভিক্ষে প্রজাদের হাহাকার এই রাজাকে আত্মবলিদানের ইন্ধন যুগীয়ে ছিল । দীর্ঘ ২৪ বছর শাসন করার পড় রাজার মৃত্যু হলে রানী বাকপুষ্টা স্মরণে যান । এর থেকে আমরা বুঝতে পারি এই সময় কাশ্মীরে সহমরণ প্রথা ছিল ।
ওপর দিকে আমরা রাজা জয়েন্দ্রর অমানবিক আচরণের পরিচয়ও পাই এই তরঙ্গে । যে বিটকগনের পরামর্শে তাঁর শৈব মন্ত্রীর সর্বস্ব হরণ করেন এবং তাঁকে ১০ বছর কারাগারে রেখে যখন তাঁর শান্তি হয় নি তিনি মন্ত্রী সন্ধিমতিকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করেন । এখানে আমরা সন্ধিমতির গুরু ঈশানের পরিচয় পাই । যিনি স্বশানের মধ্যে আলোর ছটা দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখেন যোগিনীরা মৃত সন্ধিমতির শরীরে শক্তি দান করে তাঁকে জীবিত করে তুলেছেন এবং তাঁর সাথে সম্ভোগ করছেন । সেই সময় কাশ্মীরে তন্ত্র সাধনা খুব প্রশিন্ধ ছিল তাঁর উল্লেখ এই তরঙ্গে কলহন দিয়েছেন । যোগিনীদের আশীর্বাদে এই সন্ধিমতিই পরে সন্ধিমান নাম নিয়ে কাশ্মীরের রাজা হন । অবে এই তরঙ্গে অদৃষ্টের প্রাধান্য, মদ্যপান, কামন্মাদনা, যোগিনীদের নানারকম অদ্ভুত ক্রিয়া কলাপ আমরা দেখতে পাই । স্নধিমান রাজা হয়ে সারা কাশ্মীর উপত্যকায় বহু শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । নানা জায়গায় শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি যে স্বশান থেকে নতুন জীবন পেয়েছিলেন সেখানে তিনি সন্ধীস্বর ও গুরু ঈশানের নামে ইশেস্বর শীর প্রতিষ্ঠা করেন । কোন শাসক যদি রাজলক্ষ্মীকে বিসর্জন দিয়ে মৌন ব্রত অবলম্বন করে করপুটে শিবলিঙ্গ ধারণ করে রাজ্য ত্যাগ করেন তখন কিন্তু একালের পাঠকের কাছে সেই শাসক আর গ্রহণ যোগ্য হন না ।
Comments
Post a Comment