রাজতরঙ্গিনী তৃতীয় তরঙ্গ
রাজতরঙ্গিনী তৃতীয় তরঙ্গ
দেবশ্রী চক্রবর্তী
আমাদের দৃষ্টিতে বর্তমান কাশ্মীরের যে রূপ ধরা পড়ে , তাঁর সাথে কলহনের রাজতরঙ্গিনির বর্ণিত কাশ্মীরের কোন তুলনাই হয় না । এই কাশ্মীরে আমরা বাহু দেবতার উপস্থিতি লক্ষ্য করি । তাঁদের স্ব শরীরের উপস্থিতি বাহু ঘটনায় যেমন ধরা পড়ে তেমনি কয়েক হাজার হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপের উল্লেখ আমরা এই কালজয়ী গ্রন্থে দেখতে পাই । শাসকের কৃত কর্মে আকৃষ্ট হয়ে এই গ্রন্থে বার বার দেব দেবী তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছে যা কোন কোন ক্ষেত্রে এই গ্রন্থকে লৌকিক সাহিত্যের রূপ দিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে । ভগবান ব্রুন্দেব,দেবী দুর্গা রাজা মেঘবাহনের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন । সেই সময় কাশ্মীরের রাজা ব্রাহ্মণ পুত্রের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করেন । অহিংস মেঘবাহন কাশ্মীরে পশু হত্যা নিষিদ্ধ করেন এবং বহু বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার প্রতিষ্টা করেন । এই তরঙ্গে যে রাজাদের উল্লেখ পাই তারা হলেন , মেঘবাহন, শ্রেষ্ঠসেন,হিরণ্য,তোরমান,মাতৃগুপ্ত,প্রবরসেন,যুধিষ্ঠির,নরেন্দ্রাদিত্য,রনাদিত্য,বিক্রমাদিত্য,বালাদিত্য । এই তরঙ্গে আমরা গোনন্দ বংশ থেকে কর্কট বংশে উপনীত হই ।
তৃতীয় তরঙ্গের প্রথমেই মেঘবাহনের পরিচয় পাই , যাকে প্রজারা মন্ত্রীদের সঙ্গে গান্ধারদেশের থেকে কাশ্মীরে এনেছিলেন কাশ্মীর শাসনের জন্য । তাঁর অভিষেকের দিন থেকে তিনি অহিংসার ধর্ম চারিদিকে প্রচার করেছিলেন । তিনি রাজ্যে প্রাণী বধ নিষিদ্ধ করেন এবং ব্যাধদের রাজকোষ থেকে অর্থ দান করে তাঁদের নিষ্পাপ জীবনের ব্যবস্থা করেন । তিনি বহু মঠ এবং স্তূপের প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁদের মধ্যে অন্যতম, অগ্রহার, মযুষ্টগ্রাম ও পবিত্র মেঘমঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি ভিক্ষুদের থাকার জন্য অমৃতভবন নামে একটি উচ্চ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন । এ ছাড়া ভিক্ষুরা তাঁদের স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে বসবাসের জন্য তিনি ‘নড়বনে” অত্যাশ্চারয্য বিহার প্রতিষ্ঠা করেন । মেঘবাহনের বহু স্ত্রীর উল্লেখ রাজত্রঙ্গিনিতে আমরা পাই এবং এঁরা প্রত্যেকে স্ব স্ব চেষ্টাতে বহু বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । একটি বর্ণনাতে আমরা জানতে পারি রাজা মেঘবাহন বাইরের দেশে বেড়াতে গেলে, শুনতে পান কিছু মানুষ চোর চোর করে চিৎকার করছেন । কিছুক্ষণের মধ্যে সেই চিৎকার আর শোনা গেল না । এর কিছু ক্ষণ পর কয়েকজন সুন্দরী নারী রাজার সামনে উপস্থিত হলেন এবং তাঁরা নিজেদের নাগ কন্যা বলে পরিচয় দিলেন । তাঁরা মহারাজকে জানান যে তাঁদের স্বমীদের মহারাজ শস্য নষ্ট করার জন্য বন্দী করেছেন , কিন্তু এর জন্য তাঁরা কোন ভাবেই দায়ী না, তাই তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক । মহারাজ নারীদের করুন মুখ এবং প্রার্থনা দেখে তাঁদের নাগ স্বামীদের মুক্তি দিলেন । এখানে মহারাজের দানশীলতা এবং কোমল মনের পরিচয় আমরা পাই । এই প্রসঙ্গে একটা কথা আমি এখানে উল্লেখ করছি রাজতরঙ্গিনীতে বার বার কিন্তু নাগেদের প্রসঙ্গ এসেছে । এই তরঙ্গে আমরা শবরদের উল্লেখ পাই । সেখানে শবর নিজের পুত্র এবং প্রিজনদের প্রাণ রক্ষার জন্য এক নিরীহ ব্রাহ্মণ কুমারকে বলি দিচ্ছিলেন, রাজা এই ব্রাহ্মণ কুমারের প্রাণ রক্ষা করেন এবং নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হন । এই তরঙ্গে আমরা একজন দানশীল রাজার পরিচয় যেমন পাই,সেই সঙ্গে নরবলির উল্লেখ কিন্তু পাই । এই তরঙ্গে পাঠক বুঝতে পারবেন দুটিপুত্র একজন পিতার জীবনে কত ভয়ঙ্কর দিন ডেকে আনতে পারে। শ্রেষ্টসেনের দুই পুত্র হিরণ্য ও তোরমান, তাঁদের পিতার মৃত্যুর পড় তাঁরা এঁকে অপরকে বন্দী করেন । হিরণ্য পড়ে রাজা হন এবং তোরমান হন যুবরাজ, কিন্তু তোরমান যুবরাজ হয়ে নিজের নামের মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন এবং এই কারণে তাঁর ভাই তাকে বন্দী করেন । শাসকের অহমিকা আর ক্রোধ যে কি ভয়ঙ্কর তা শব যুগে শব ধর্ম্যাই প্রমাণ পাওয়া যায় । রাজতরঙ্গিনী যত পড়ছি, একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার যে কাশ্মীরের ইতিহাস চিরকালই লাল রক্তে লেখা ইতিহাস । জনকল্যাণ কারি রাজারা তাঁদের রাজত্বকালে কাশ্মীরে শান্তি এবং উন্নয়নের জোয়ার আনলেও পরবর্তী শাসকের সময় তা রক্তের বন্যায় ধুয়ে মুছে গেছে । রাজা প্রবরসেনের নির্মিত বিতস্তার সেতু প্রজাক্ল্যানে এক অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা । তাঁর সময় এক দিকে পাশুপত মঠ প্রতিষ্টা, অপরদিকে বিশাল্মাপের বুদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠা কাশ্মীরের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে । তোরমান যখন কারা রুদ্ধ ছিলেন, তখন তিনি লুকিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেন এবং এই সময় তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন , লোক লজ্জায় সেই পুত্রকে এক কামারের কাছে পালনের জন্য রেখে আসে তাঁর মা, সেই সন্তানই হচ্ছেন প্রবরসেন, কারামুক্ত হবার পড় তোরমান বেশি দিন বাঁচেন নি, ত্বরমাণের মৃত্যুর পর প্রবরসেন তাঁর মাকে সহমরণ থেকে রক্ষা করেন এবং আজীবন মায়ের সেবা করেন । কাশ্মীরের ইতিহাস প্রবরসেনের মতন সুশাসকে তাই যুগ যুগ ধরে মনে রেখেছে । এই পর্বে আমরা মাত্রিগুপ্তের মতন একজন মহাজ্ঞানী শাসকের উল্লেখ পাই, যিনি কাশ্মীরের সিংহাসন পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলেন উজ্জ্যিনির মহান শাসক বিক্রমাদিত্যের সময় । এবং বিক্রমাদিত্য যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি তত দিন ী কাশ্মীরে রাজত্ব করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পড় মাত্রিগুপ্ত কাশ্মীরের সিংহাসন ত্যাগ করে কাশীতে যান এবং তাকে কাশ্মীরের রাজস্ব প্রতিমাসে পাঠালে তা তিনি গ্রহণ না করে ভিক্ষা করে জীবন কাটান । এই পর্বে যেমন সেই যুগের কাশ্মীরে সতীদাহের উল্লেখ পাই, তেমনি যোগ্য কন্যা থাকার পরও জামাইয়ের সিংহাসনে আরোহন প্রমাণ দেয় সেই যুগে নারী তাঁর স্বাধীনতা কতটা ভোগ করত । শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলি সেই যুগে নারী কিন্তু স্বামী থাকার পরও অন্য পুরুষের সাথে সম্ভোগে লিপ্ত হতেন, তাঁর উল্লেখ রাজতরঙ্গিনীর তৃতীয় তরঙ্গে পাই ।
Comments
Post a Comment