দর্পণ

দর্পণ

দেবশ্রী চক্রবর্তী 



সময় তো দর্পণের মতন থেমে থাকে না , সময় নদীর স্রোতের মতন বয়ে চলে । তবু দর্পণের প্রতিবিম্বের মতন কিছু ছবি সময়ের স্রোতের মধ্যে স্থির হয়ে থাকে । দেশ বিভাগের পর দুটি নতুন দেশের কর্ণধার হয়েছিলেন দুই বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার । দুজনেই পাক্কা সাহেব । সাহেব হবার পরীক্ষায় শুধু সঠিক উচ্চারণের ইংরেজি ভাষণেই নয় , এক ধরনের আলাদা হাসি রপ্ত করতে হয় । সংবাদ পত্রে প্রকাশিত ছবি গুলি তুলনা করলেই বোঝা যায় যে দুজনেই বেশ কিছু দিন সেই বিলিতি হাসির প্রতিযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিলেন । দুজনেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা অয়াগ্নেস্টিক, অর্থাৎ ঈশ্বরে উদাসীন । সেটাই তো বিশ্ব নাগরিকের আধুনিকতা । সামান্য নেটিভদের মতন তিনি বা তাঁরা পুজো,নামাজ এ বিশ্বাসী নন  । কিন্তু পুরনো ব্রিটিশ শাসকদের নীতি অনুসরণ করে তাঁরা কোনও ধর্মীয় সংস্কার বা ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রচারের ব্যাপারে মাথা ঘামালেন না । যে দেশে শতকরা নব্বই ভাগ লোক কুসংস্কার তাড়িত , সামান্য বাইরের প্ররোচনাতেই ধর্মের নামে হাতিয়ার তুলে নেয়, কোথায় কোথায় রক্তের স্রোত বয়ে যায় , যারা ধর্মের কিছুই বোঝে না অথচ তারাই মারে অথবা মরে, সেই দুই দেশের প্রধান হয়ে রইলেন এমন দুইজন ব্যক্তি যারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্যাকে অরুচিকর বিবেচনায় আত্মশ্লাঘা মনে করতেন ।  দেশ ভাগের সময় পাঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে দুই দেশ থেকেই ট্রেন ভরতি মৃত দেহ যেত । কিন্তু সকলে নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকায় , নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য সে দিন এরাই দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু দেশ নায়ক হিসাবে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব এরা নিতে পারেন নি । পাঞ্জাব বর্ডারের তো এই চিত্র, বাংলার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়ঙ্কর । শিয়ালদহ  স্টেশানে পুরব বঙ্গ থেকে আগত রিফিউজি দের অবস্থা দেখলে চোখে জল এসে যেত । কলকাতার রাস্তাঘাট এই সব অসহায় মানুষদের বজ্রপদারথে ভর্তি হয়ে থাকত, তার মধ্যেই লাখ লাখ মানুষের সহাবস্থান । সেই অর্থে এঁদের পুরনবাসন  নিয়ে কারুর কোন মাথা ব্যাথা ছিল না । আমার শ্রদ্ধেয় দাদামশাই শ্রী বিনয়ভূষণ বন্দোপাধ্যা তার বই “ শতাব্দীর আলো আঁধারে “ তে লিখে গেছেন , পূর্ব বঙ্গীয় মাদের দেখলে সম্ভ্রমে মাথা নত হয়ে যেত, শত জীর্ণ শাড়ি, কাঁখে সন্তান, মায়ের সারা শরীর নোংরা ব্রজ পদার্থ লেগে আছে, তবুও যে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন । আমার দাদা মশাই তার নদীয়া জেলার জাগুলির বহু জমি সেই সময় পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত অসহায় পরিবার দের দান করেছিলেন বসবাসের জন্য । 

লিটন আব্বাস ভাইয়ের জন্য দেশভাগ নিয়ে একটি নাটক লিখছি । আমি যখনি কিছু লেখা আরম্ভ করি, তার আগে একটু পড়াশুনা করে নি , এতে তথ্য সমৃদ্ধ লেখা লেখা যায়, ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয় না । নারায়ণ সান্যালের একটি বই আমাকে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে , যে বইটিতে তিনি লিখেছেন যে নেতাজীর রহস্য সন্ধানে যখন তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে গেছিলেন, সেখানে গিয়ে তিনি একটি তামিল খ্রিস্টান মেয়ের একটি ডাইরি পান । মেয়েটি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যা ছিলেন । মেয়েটি তার ডাইরিতে লিখেছেন, নেতাজী ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, যার চোখে সবাই ছিলেন সমান । তার বাহিনীতে হিন্দু, মুসলিম , শিখ সকল সদস্যের এক অপূর্ব মেল বন্ধন ছিল । মেয়েটি তার লেখাতে একটি মুসলিম ছেলের কথা লিখেছেন । ছেলেটি বর্তমান পাকিস্তানের কোন একটি অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন । তারা এঁকে অপরকে প্রাণের মতন ভালোবাসতেন । এক দিন নেতাজী কোন একটি সভাতে গেছিলেন । কুচ কাওয়াচ চলছে, নেতাজী মাঠের একটি প্রান্ত থেকে আরেটি প্রান্ত হেঁটে যাচ্ছেন । এমন সময় কোথা থেকে গুলি চলা শুরু হয়, মাঝ বয়সী একজন মানুষের পক্ষে জোড়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা । সেই সময় ওই মুসলিম ছেলেটি নেতাজীকে গার্ড দিয়ে নিজের সারা শরীরে গুলি বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন । এঁদের কথা কিন্ত ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় না । এই বইটি পড়তে গিয়ে আরেকটি তথ্য পেলাম । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানের অবস্থা তখন খুব খারাপ । আজাদ হিন্দ বাহিনীর অস্ত্র, খাদ্যর যোগান প্রায় বন্ধ । এমন সময় একটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আত্ম গোপন করে দীর্ঘ দিন পায়ে হেঁটে চলতে হয় বাহিনীকে ।  নেতাজীকে সবাই বলেছিল, আপনি গাড়ি করে অন্য পথে চলে যান, এই পথে আপনার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না । কিন্তু নেতাজী স্বার্থপরের মতন সবাইকে ছেড়ে চলে যান নি । এক দিন সন্ধ্যে বেলা জঙ্গলের একটি জায়গায় ক্যাম্প করা হয় । সেখানে বহু দিন পর জুতো খোলেন নেতাজী । সবাই অবাক হয়ে যায় যে সারা পায়ে বিশাল বড় বড়  জল ফোস্কা । এই যন্ত্রণা নিয়েও চুপ করে তিনি পথ চলেছেন । একেই বলে হয় তো প্রকৃত দেশ নায়ক । 

দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছিল । কিন্তু সাধারণ মানুষ কি দেশ ভাগ চেয়ে ছিল ? এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য তুলে ধরতে চাই । খান আব্দুল গফর খান, যিনি সীমান্ত গান্ধি নামে পরিচিত ছিলেন, তার জীবনী পড়ে জানতে পেরেছি না সাধারণ মানুষ দেশ ভাগ চান নি । উত্তর পশ্চিম সীমান্তের মানুষ দেশ ভাগের স্বপক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট দেন নি । কিন্তু রাতা রাতি কারুকে কিছু না জানিয়ে উত্তর পশ্চিম সীমান্তকে দিয়ে দেওয়া হয় । খান আব্দুল গফর খান যখন জানতে পারেন তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন । পরবর্তী কালে তাকে পাকিস্তানের জেলে বন্দী করা হয় । কারুকে দেখা করতে দেওয়া হত না তার সাথে । এক বার এক সাংবাদিক ছদ্মবেশে গেছিলেন দেখা করতে । খান সাহেব কে যখন তিনি প্রশ্ন করেন, আপনার ভয় করে না এই সব নেকড়েদের মাঝ খানে থাকতে ? তখন তিনি উতরে বলেছিলেন ভয় কি জিনিশ , সেটাই তো আজ পর্যন্ত বুঝলাম না । খান সাহেবের জীবনের আরেকটি ঘটনা পাঠকদের সাথে ভাগ করতে খুব ইচ্ছা করছে । একবার তাকে আদালতে তোলা হয় । তখন এক ব্রিটিশ জাজ তাকে বলে, আপনি তো গান্ধীবাদি কাপুরুষের বাচ্চা । তখন খান সাহেব নিজের হাতের থেকে লোহার একটা কড়া বাড় করে বেঁকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন । আমার শরীর এটা পারে, কিন্তু আমার মাথা বলে হিংসার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব না । 

 আমার লেখা শেষ করব এমন একজন মানুষের কথা দিয়ে যাকে হয় তো অনেকেই চেনে না । সাংবাদিক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের একটি লেখা একবার পড়েছিলাম , উনি সৌরভ এর  টিম ইন্ডিয়ার সাথে এক বার পাকিস্তান গেছিলেন । সেখানে পাকিস্তান  ক্রিকেট টিমের যে ফিজিও থেরাপিস্ট ছিলেন সেই ভদ্রলোক তাকে একজনের সন্ধান দেন যে আফগানিস্থান সীমান্তের ডাক ইসমাইল খেলে থাকেন, তার নাম, আমির খান খাটক । একশো ঊর্ধ্ব এই অন্ধ বৃদ্ধ সেই সময় পাকিস্তানে ফরোয়াড ব্লকের এক মাত্র জীবিত সদস্য । ওনার সাক্ষাৎকার নিতে ছুটে  গেছিলেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় । সেখানে গিয়ে জানতে পারেন নেতাজীকে তিনিই আফগানিস্তান বর্ডার পার করে কাবুলে পৌঁছে দিয়েছিলেন । বহু দিন নেতাজী বোবা সেজে ডাক ইসমাইল খেলে ছিলেন । ফেরার সময়  আমিরখান খটককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার কেমন লাগে যখন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ? বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন । তার পর তিনি বলেছিলেন , “ যব ভাই ভাইকে সাথ লড়তে হে, তব বহত খারাপ লাগতা হে । “ বৃদ্ধের চোখ আজ পৃথিবীর  আলো দেখতে পায় না । কিন্তু সেই চোখেও জল ঝড়ে ছিল সে দিন । 


কিছু সুবিধাবাদী মানুষের জন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে । আমাদের ইতিহাস মাথায় রাখা উচিত । কারুর কথায় না, নিজের বুদ্ধি দিয়ে কোনটা  ঠিক, কোনটা ভুল এটা বিচার করা উচিত । সব হিংসা বিবাদ এখানে শেষ হোক, আমরা সবাই মিলে মিশে পৃথিবীকে আগামীর বাসযোগ্য করে তুলি । 

Comments

Popular Posts