আমার কাশ্মীর পর্ব ২

আমার কাশ্মীর 

দেবশ্রী চক্রবর্তী 

কাশ্মীর , আমার ভালবাসার ভূস্বর্গ , তোমাকে নিয়ে যত লিখি লেখার আকর্ষণ ততই বারতে থাকে । আজ সাম্প্রদায়িকতার বীজ ও কাশ্মীর নিয়ে লেখার জন্য কলম ধরেছি । কাশ্মীরের ওপর হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম সব শাসকরা রাজত্ব করেছেন, কিন্তু হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় ছিল, তবে এমন কি ঘটল যে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলে উঠল এই ভূখণ্ডে ? এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ চরিয়েছিলেন ইংরেজরা , নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য । 

আজ কাশ্মীরের যে ইতিহাস বলতে যাচ্ছি, সে ইতিহাস জানার জন্য আমাদের পৌঁছে যেতে হবে দেড়শত বছর আগে । কাশ্মীরের ডগরা রাজারা ছিলেন ইংরেজদের বন্ধু, সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও তাঁরা ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু ইংরেজরা এমন এক জাত  যেরা সু দিনে দুর্দিনের বন্ধুকে মনে রাখে না । বিপদ কেটে যেতেই ইংরেজরা ভুলে গেলেন ডগরা রাজবংশের উপকার । ততদিনে ইংরেজরা বুঝতে পেরেগেছিলেন কাশ্মীরের সামরিক গুরুত্ব । রাশিয়ার জারকে রুখতে গিলগিটে দুর্গ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে , শুরু হয়ে গেল কূট কৌশল , রনবীর সিং এর বড় ছেলে প্রতাপ সিংহ ছিলেন নেহাত ভালো মানুষ, তিনি ধর্ম কর্মে বেশি মন নিবেশ করলেন , এই সুযোগে ইংরেজরা কাশ্মীরে বসালেন নতুন রেসিডেন্সি । তাঁর কর্তা হয়ে এলেন স্যার অলিভার সেন্ট জন, কাশ্মীরের প্রথম রেসিডেন্ট । 

রাজা প্রতাপ সিং এর ভাই ছিলেন অমর সিং, তাকে ইংরেজরা কাশ্মীরের সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে হাত করে নিলেন, ভাই অমর সিং দাদার সরলতার সুযোগ নিয়ে সাদা কাগজে দাদার সি নিয়ে কাশ্মীরের সিংহাসন নিজের নামে লিখিয়ে নিলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ জানলেন প্রতাপ সিং ধর্ম কর্মে মন নিবেশ করতে চান, তাই ভাইকে সব সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিলেন । দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহ বন্দী থাকার পর প্রতাপ সিংহ একটি চিঠি লিখলেন বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের কাছে । মহারাজ লিখলেন তাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হোক, কিংবা বুকের মাঝে গুলি করে হত্যা করা হোক । এ অপমান এবং যন্ত্রণার জীবন যে আর তাঁর ভালো লাগে না । কলকাতার খবরের কাগজে কাশ্মীরে ইংরেজদের জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হল, পার্লামেন্টে ঝড় উঠল । উদারনৈতিক সদস্য চার্লস ব্র্যাডলে মহারাজের পক্ষ নিলেন, উইলিয়াম ডিগবি ছিলেন সেকালের একজন ন্যায় নিষ্ট ইংরেজ । তিনি মহারাজের প্রতি অবিচারের জোরালো প্রতিবাদ করলেন । অগত্যা ইংরেজ সরকারকে প্রতাপ সিং কে কাশ্মীরের সিংহাসন ফেরত দিতে হয় । ক্রমে মহারাজের চুলে পাক ধরল, চোখে পরল ছানি, মহারাজের কোন পুত্র নাথাকায় মৃত্যু শয্যায় তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্যি দিয়ে গেলেন তাঁর ভাই অমর সিংহের পুত্র হরি সিঙকে । 

হরি সিং সিংহাসনে বসে প্রজাদের মঙ্গলের কথা ভেবে কাজ করতে থাকেন, তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজা যিনি লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে গিয়ে বলেছিলেন যে ভারতের শাসনভার ভারতীয়দের হাতেই দেওয়া উচিৎ । ভারতীয় রাজার মুখে এমন কথা ? ইংরেজ সরকার খুশি হলেন না, কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন যুগীয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা শুরু হল । 
ওদের হাতিয়ার ছিল কাশ্মীরের সরল অজ্ঞ মুসলিম প্রজাদের উস্কে দেওয়া । অয়েকফিল্ড নামে একজন ইংরেজ ছিল মহারাজের মন্ত্রী,তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হল কাশ্মীরের মুসলিম প্রজাদের ক্ষেপিয়ে তোলা । কাশ্মীরের মুসলিম প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে হিন্দু রাজা এই বলে প্রচার চালাতে থাকেন পাঞ্জাবের অড়হর আর মহম্মদীয়া দোলের নামজাদা সাম্পদায়িক নেতারা এবং কয়েকটি উদুকাগজে তাঁর প্রচার চলতে থাকে । পত্রিকা গুলি বিনা মূল্যে দেওয়া হতে থাকে কাশ্মীরের মুসলমানদের । কাশ্মীরের বুক থেকে উঠে এলো তরুণ শিক্ষিত নেতা শেখ আবদুল্লা । 

ভারতবর্ষের বুকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ান হতে থাকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং আলিগড়ের কলেজের অধ্যক্ষ মিস্টার বেক আর থিওড্র মরিসন সে মাটিতে যুগিয়েছিলেন সাড় ও জল । কাশ্মীরে যখন সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের চারা বোনার কাজ শুরু হয় তখন মহারাজ বিদেশে ছিলেন , এই সময় প্রথম কাশ্মীরের বুকে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয় । 

এই ঘটনার কয়েক বছর পর আব্দুল্লা গেছিলেন পেশোয়ারের একটি সভায় , সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি দেখলেন একজন মুসলিম জমিদার তাঁর হিন্দু প্রজাদের দিয়ে আমবাগানে কি অমানবিক পরিশ্রম করাচ্ছেন, কেউ যদি ঠিক করে কাজ না করতে পারেন তাঁর পিঠে জুটছে চাবুকের বাড়ি এবং পারিশ্রমিকও কেটে নেওয়া হচ্ছে । এই সময় আব্দুল্লা প্রথম অনুভব করলেন গরিব মানুষের কোন ধর্ম হয় না । পরে তিনি বহু হিন্দু মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং দরিদ্র হিন্দুর মৃত্যু হলে তাঁর শেষকৃত্যের দায়িত্বয়ও নিয়েছিলেন । 

এবার বলব ব্রিগেডিয়ার ওসমাইনের কথা । তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমী, একবার এক সাম্প্রদায়িক মুসলিম নেতা বিলেতে তাঁকে বলেছিলেন ও আপনি জাতিতে মুসলমান, আমিও তাই , জেনে খুব খুশি হলাম, 

ওসমাইন বলেছিলেন আমি জাতিতে ভারতীয়, তবে ধর্মের দিকে আমি মুসলিম । দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন মুলতানে, দেশভাগের বহু বিভীষিকা লক্ষ্য করেছেন নিজের চোখে । বহু হিন্দু ও শিখ পরিবারকে সাহায্যও করেছেন । গান্ধীজীর হত্যার পর মাছ মাংস ছেঁড়ে দিয়েছিলেন ।  

ব্রিগেডিয়ার ওসমাইন পাকিস্তানি দখলদারদের কাছ থেকে কাশ্মীরের নউশেরা,ঝাংগড়, রাজউরী, পুঞ্জ রক্ষা করেছিলেন । যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি, পুষ্পস্তবক সাজিয়ে বীরের মৃতদেহ বিমানযোগে নিয়ে আসা হয় দিল্লি । সেখানে হিন্দু,শিখ , খ্রিস্টান,পারসিক, মুসলমানেরা শ্রদ্ধা ভরে ফুল দিয়েছিলেন শবাধারে । জাতীয় পতাকায় ঢেকে কামানের গাড়িতে হল পূর্ণ সামরিক সম্মানে স যাত্রা । শবানুগমন করলেন স্থল, নৌ , বিমানবাহিনীর তিন সরবাধক্ষ । 


আমার লেখা শেষ করব ব্রিগেডিয়ার প্রতীপ সেনের কথা দিয়ে । ব্রিগেডিয়ার সেনের জন্যই পুঞ্জে প্রথম ভারতের পতাকা উত্তলিত হয়, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় । 

Comments

Popular Posts