প্রতীক্ষার কালচক্র ১
প্রতীক্ষার কালচক্র ১
দেবশ্রী চক্রবর্তী
আর কতটা পথ গেলে একটা বৃত্ত সম্পূর্ন হবে কে জানে, আর কতটা পথ গেলে আর কোন কিছু প্রবেশ করতে পারবে না এই বৃত্তের মাঝে। বিছানার চাদরের ওপর অর্ধবৃত্ত এঁকে চলেছে বিহু। হাতের আঙ্গুল পূর্ন গোলকের দিকে এগিয়েও যেন এগতে পাড়ছে না। কোথাও যেন একটা শক্তপোক্ত বাঁধা পাচ্ছে তাঁর আঙ্গুল। জানালা দিয়ে ঝরো হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে তাঁর গালে, চোখের ঘন কালো পাতায় বিন্দু বিন্দু জল জমে চারদিক আবছা হয়ে আসছে। আজকাল যেন ব্লটিং পেপারের মধ্যে দিয়ে আবঝা পৃথিবী দেখেই সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। প্রকৃতির রঙ গুলো যেন সব মিলে মিশে এক হয়ে এক ধোঁয়াশা তৈরি করেছে । এক বৈচিত্রহীন জীবনের গোলোক ধাঁধার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে আজ সে বড় ক্লান্ত।
বুকের মধ্যে কুশানটা চেপে ধরে সে তাকিয়ে দেখল জানালার বাইরের ধূসর আকাশের দিকে। ঘন কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি উড়ো জাহাজ, যাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, তবে তাঁর গগণ ভেদী আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যে ৬ টা ২৫ বাজে। মানে হাতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। এর পর এক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব পরিণত হবে আরো কয়েক হাজারে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতরটা কিরকম যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তাঁর পর চোখ দিয়ে বইতে শুরু করল বাঁধন হারা জল। মুখ খুলে কাঁদার মতন পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি কোনটাই নেই, তাই দাঁতে দাঁত দিয়ে যন্ত্রণা সহ্য করে নীরবে কেঁদে চলল সে। সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। নীচে রান্না ঘর থেকে বাসনের আওয়াজ আসছে, পাশের ঘর থেকে আসছে বাংলা খবরের শিরনাম। তারই মধ্যে বিহু নিজের ঘরের চিত্রপটের পরিবর্তন অনুভব করল। ঘরটা হঠাত অন্ধকার হয়ে গেল। সারা ঘর অন্ধকার, কিন্তু ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা সার্চ লাইট এসে পড়ছে। সেখানে একটা আয়নায় মুখ দেখছে জগদীশ। তাঁর শরীরের ওপর এত উজ্জ্বল আলো এসে পড়ায় তাঁর শরীরের রঙের অদ্ভুত এক পরিবর্তন হয়েছে। ৬২ বছরের মানুষটিকে শেক্সপিয়রের নাটকের কোন চরিত্র বলে মনে হচ্ছে। কোন চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন এ রূপ তা সে বুঝতে পাড়ছে না, তবে প্রসপ্যারোর মতনই যেন লাগছে। চোখে মুখে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ছাপ, শরীরের মধ্যে যৌবনের লেশ মাত্র নেই, অথচ এক অদ্ভূত পুরুষত্বের প্রকাশ। এই আকর্ষনকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না সে। এই আকর্ষনের টানে সে প্রতীক্ষা করতে পারে আরো কয়েক হাজার বছর। জগদীশ সাদা রঙের একটা গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার দিকে। বিহু ভালো করে তাকিয়ে দেখল তাঁর চোখে মুখে হাল্কা কালো রঙের ছোপ, ঠোঁট দুটো হাল্কা ভাবে নড়ে উঠল। কথা গুলো খুব আস্তে বললেও খুব দৃঢ় আর স্পষ্ট সে উচ্চারণ। জগদীশ আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
আমি আজ সারা দিন অনুভব করেছি তোমার অনুভূতি। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার যন্ত্রণা যে কি ভয়ংকর তা বুঝতে পেরেছি বিহু। তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম, তাহলে হয় তো কবে পাগল হয়ে যেতাম।
কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল, আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, তোমার অধিকার থেকে আর কোন দিন বঞ্চিত করবো না তোমায়।
বিহু লক্ষ্য করছে ঠোঁট ছাড়া জগদীশের শরীরের কোন অংশ আর কাঁপছে না। কথা গুলো যান্ত্রিক ভাবে বলে চলেছে সে। যেন কাঠের এক পুতুল। মঞ্চে অভিনয় করতে করতে নিজের অজান্তে কখন যেন সে এক পুতুলে পরিণত হয়েছে। মাঝখানের সার্চ লাইটটা ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে আসতে শুরু করলে দুটি সুতো দেখতে পায় সে। সুতো দুটো দিয়ে জগদীশের দুটি হাত বাঁধা।এতক্ষণ তীব্র আলোর জন্য সুতোটা দেখতে পায়নি সে। ওপর থেকে অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় টান পড়ল সেই সুতোতে। তখন কাঠের পুতুলের মতন হাত দুটো নাড়াতে নাড়াতে সে চলে গেল আয়নার পেছনে। সার্চলাইটের আলোটা নিভে যেতেই চিত্রপট আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
এই আছে তো এই নেই, তবে কেন কাছে আসা। নিজেকের খোলসটা যখন সম্পূর্ন ভাবে খোলেও না সে, হাল্কা একটা জ্যোতির প্রকাশ হলেও পুরো খলশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই ব্রহ্মাণ্ডের হদিশ পাওয়া যেন সম্ভব না । তাঁর আর সেই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেকার দূরত্ব যেন কয়েক হাজার আলোক বর্ষ।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে বসে চোখ বন্ধ করে কাঁদছে সে, বুকের ভয়ংকর আর্তনাদকে দু হাতে চেপে কেঁদে চলেছে। এ যেন কোন মুখাভিনয় করছে সে। সুখ দুঃখের প্রকাশ স্পষ্ট হলেও, কোন রকম আওয়াজ করা যাবেনা। এ আর্তনাদ একবার তাঁর মুখ ফুটে প্রকাশ পেলে মহামারীর মতন ছড়িয়ে পরবে চারি দিকে। তারপর চোখের পলকে সুজলাসুফলা সৃষ্টি পরিণত হবে শ্মশানপুরীতে।
না, সে যা সৃষ্টি করে নি, তাকে ধ্বংস করারও কোন অধিকার তাঁর নেই।
বিহুর কানে মৃদু সুরে ঢোলের আওয়াজ আসতে শুরু করল। কাছে পিঠে যেন কেউ ঢোল বাজাচ্ছে। তাঁর মনে হল এ যেন তাঁর বুকে জমে থাকা যন্ত্রণাদের আর্তনাদ। বুকের মধ্যে তারা দাপাদাপি করছে বলে এরকম আওয়াজ আসছে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। বিহু চোখ খুলে দ্যাখে মুখোশ পড়া একদল মানুষ তাঁর চারদিকে নৃত্য করে চলেছে। হাল্কা আলো আধারির মধ্যে সে দেখতে পেল ঘরের এক কোনে বসে একজন ঢোল বাজাচ্ছে আর মুখোশধারিরা নৃত্য করছে। সে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করল এ কিসের মুখোশ। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষন করে সে বুঝল এরা সবাই নাগ। চারপাশ থেকে নাগেরা নৃত্য করে তাঁর প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। ঘরের এক দিকে বন্ধ দরজা। বিহু উঠে সেই দরজা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু সে দরজা কিছুতেই খুলল না। এক বন্ধ বাড়ির মধ্যে সে বন্দী। এ যন্ত্রণা আর এই চিত্রপটের সাথে যেন তাঁর বহুদিনের সহাবস্থান। দরজার উল্টো দিকের অন্ধকার কোনায় একটা আলো জ্বলে উঠল। সেখানে বিহু নিজেকে দেখতে পেল। জায়গাটা দেখে যেন মনে হয় কোন রান্নাঘর। বিহুর পোশাক আসাক সব কিছু মধ্যযুগীয় এক নারীর মতন। সে বসে বসে কাঁদছে। তাঁর হাতে একটা গ্লাসের মধ্যে কিছু রাখা আছে। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করার পর সে গ্লাসটা উল্টে দিলো একটা গর্তে। গ্লাসে জমে থাকা তরল সবটা জমা হল সেখানে। এরপর বিহু কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলল অন্ধকারের দিকে, এতক্ষণ বর্তমানের বিহু যেখানে বসে ছিল, সেখানে একটা কাঠের বিশাল পালঙ্ক এখন । সেই পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে। বিহু দেখতে পাচ্ছে তাঁর স্বপ্নের এই বিহুর এক কপাল সিঁদুরে ঢাকা, তাঁর দু চোখ দিয়ে কাজল গলে গাল দিয়ে পড়েছে। কাজলের কালো গভীর রেখা যেন দুটি গভীর নদী খাঁদ।
অতীত আর বর্তমানের দেখা দুটি চিত্র কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। এক অনুভূতি, একই যেন পরিস্থিতি। এইভাবেই হয় তো বারবার ফিরে আসে বলেই একটি বৃত্ত পূর্নতা পায় না। এক উষ্ণ মরু ঝড় যেন আবর্তিত হয়ে চলতেই থাকে।
বিহু বুঝতে পাড়ছে না যে সে স্বপ্ন দেখছে না এ সময় পরিক্রমায় চলেছে সে। তবে চিত্রপট দেখে তাঁর বুঝতে ভুল হয় না যে এই দৃশ্য লন্ডনের ফিফটিন ইস্ট ড্রামা স্কুলের মঞ্চের। আর যে নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে তাঁর নাম নাগমন্ডলম। ছয় বছর আগে যার নির্দেশনায় এই নাটকটি মঞ্চস্ত হয়েছিল, তাঁর অঙ্গুলি হিলনে এক মরু ঝড়ের মতন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছিল তাঁর গোটা জীবন।
এখন আর ঢোলের শব্দটা সে পাচ্ছে না। তবে তাঁর সোজাসুজি সামনের দেওয়ালটা যেন একটা মোবাইল স্ক্রিনে পরিণত হয়েছে। সেখানে সে দেখতে পারছে এক বৃদ্ধকে। যে হাতে মদের গ্লাস নিয়ে সোফায় বসে আছে আর ঢুলু ঢুলু চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলছে, তুমি কি মনে কর আমি সুখী?
লোকটা কথা গুলো বলতে বলতে একটু থেমে যাচ্ছে। হয় তো নেশার ঘোরে এরকম হচ্ছে। তারপর সে আবার বলতে শুরু করল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে মুখটা একটু বিকৃত করে সে বলল, আমরা সবাই এক একটা বিচ্ছিহ্ন দ্বীপের মতন বুঝেছেন। আমি তুমি সবাই। তাই দুঃখ পেয়ো না। বিহু নিজের অজান্তে বলে ফেলল, মাঝে মাঝে তো বহু দ্বীপ ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি এসে মিলে মিশে একটা মহাদেশে পরিণত হয়। তারপর সেখানে সৃষ্টি হয় এক নতুন জীব বিচিত্র। বিচিত্রের মধ্যেই তো আনন্দ তাই না। আর তখন তারা তো আর একা থাকে না।
লোকটা তাঁর ডানদিকে তাকাতেই রান্নাঘরের গর্ত থেকে ধোঁয়া বেরতে থাকল। ধোঁয়াটা একটা সাপের রূপ নিয়ে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলল খাটের ওপর ঘুমন্ত বিহুর দিকে। বর্তমানের বিহু স্বপ্নের বিহুর দিকে আবেগ ঘন দু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। সূর্য দেবের প্রথম আলো যেমন ধরিত্রীর ওপর এসে পরে ,ঠিক সেই ভাবেই ধোঁয়াটা ঘুমন্ত বিহুর সারা শরীরটা যেন ঘিরে ধরল। তারপর সেই ধোঁয়া এক নাগের রূপ ধারণ করে বিহুর সারা শরীর প্রদক্ষিণ করে তাঁর পায়ের কাছে এসে এক পুরুষের রূপ ধারণ করল। বিহুর মনে হল ঠিক যেন তাঁর স্বামীর রূপ ধারণ করেছে নাগরাজ। তাহলে কি কয়েক শত বছর আগেও যখন তাঁর জন্ম হয়েছিল, তখনো প্রতাপ ছিল তাঁর স্বামী। সে যা দেখছে তা তো সময় পরিক্রমা ছাড়া আর অন্য কিছু না। মানুষ জেগে জেগে কিভাবে এসব স্বপ্ন দেখতে পারে। নিজেকে বারবার চিমটি কেটে সে বুঝতে পেরেছে যে সে ঘুমিয়ে নেই।
নাগরাজের সারা মুখে গভীর এক প্রেমের প্রতিফলন সে দেখতে পেল। সে ধীরে ধীরে বিহুর পা টিপে দিচ্ছে, ঘুমন্ত বিহু গুংগিয়ে কেঁদে উঠছে। যা দেখে নাগরাজের মনে বাঁধ ভাঙ্গা এক বাৎসল্যের প্রতিফলন সে দেখছে। একদিকে একজন পিতা আরেক দিকে সে যেন এক প্রেমময় পুরুষ। এই দুইয়ের সমন্বয়ে অসাধারণ হয়ে উঠেছে চরিত্রটি। দুটি বিচ্ছিহ্ন দ্বীপের একটি আরেকটির দিকে ধীরে ধীরে যেন এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে আলো কমতে কমতে জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল। এবার সার্চ লাইটের আলো এসে পড়ল ঘরের মাঝখানে রাখা আয়নার ওপর। এখন আয়নাটাকে আর আয়না বলে মনে হচ্ছে না। এতো একটা খোলা দরজা। দরজার এক পাশে পর্দা উড়ছে। খোলা দরজার বাইরে একঝাক সাদা বক উড়ে গেল। বাইরেটা একটা ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে একটা বাঁধানো রাস্তা এঁকে বেঁকে এগিয়ে এসেছে দরজার দিকে। এক বহু প্রতীক্ষিত মুহুর্তের অবসান হতে চলেছে। দরজার এক কোনে কমলা রঙ এর ঢাকাই শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। বিহুর এক ঢাল কোঁকড়া কালো চুল বিছিয়ে আছে মেঝের ওপর। ঠিক যেন কাজলা দীঘির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাঁর চোখের প্রতীক্ষার গভীর কাজল রেখার প্রতিফলন পড়েছে দীঘির জলে। বাগানের রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা হলুদ রঙের গাড়ি এসে দাঁড়াল। হলুদ গাড়িটা যেন একটা হলুদ পাখী। বাগানের গাছ থেকে ইষ্টিকুটুম ডেকে উঠল। বিহুর মনে তখন মৃদঙ্গ, ঢোল আর করতালের সুরে গীতগোবিন্দম গীত হচ্ছে। গাড়ির থেকে নেমে আসছে জগদীশ। এই তো প্রথম দেখা। শুভদৃষ্টির আগেই সে দেখে নিয়েছে তাঁর প্রিয় মানুষটিকে। কম্পিউটার আর মোবাইলের পর্দায় দেখা ছবি আজ হেঁটে চলে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, যেন কালবৈশাখীর প্রচণ্ড বেগবান এক ঝড়।
বিহু প্রহর গুনতে শুরু করল। আর কয়েক মুহুর্তের অপেক্ষা, তারপর এত দিনের প্রতীক্ষার সাথে সাথে তাঁর দর্পচূর্ন হল। নিজেকে মাঝে মধ্যে চিতরের রানী পদ্মিনীর মতন মনে হত তাঁর। চিতরের রানীর মতন সে সতী লক্ষ্মী নারী। কিন্তু আর কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সে সতী থেকে অসতীত্বে পরিণত হবে। একটা অক্ষরের এদিক ওদিক হলে কত বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। গোটা জীবনের মানচিত্রটাই যেন বদলে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জগদীশ বেশ কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। চারদেওয়াল আর খোলা প্রকৃতির মাঝখানে একটি দরজা। যার দুই দিকে আকাশ পাতাল তফাৎ। এই দরজার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ আর এক নারী। দুজনের চোখ এমনভাবে আটকে গেছে, যেন চুম্বক আর লোহা। বিহু ছবিতে যেমন দেখেছিল, জগদীশ তখনো অতটা বৃদ্ধ হয়ে যায় নি। তাঁর সারা শরীরে একটা পুরুষালী ব্যাপার আছে, যা হয় তো তাঁর স্বামীর মধ্যে সে খুঁজে পায়নি। জগদীশ বলল,
-তুমি বিহু ?
বিহু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে তাকে ভেতরে চলে আসতে বলল। কেউ দেখে ফেললে মহা বিপদ হয়ে যাবে যে। দরজা দিয়ে জগদীশ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়া খেলে গেল সারা ঘরে। তারপর একটা উজ্জ্বল সাদা মেঘ যেন শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল তাকে। কিছুক্ষণ ধরে কয়েক পশলা বৃষ্টি হল। কতক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল তা আর আজ তাঁর মনে নেই। পারিপার্শ্বীক কোন কিছুই তাঁর সেই মুহুর্তে মনে ছিল না। সে শুধু বৃষ্টির প্রতিটা বিন্দুকে গভীরভাবে অনুভব করছিল তাঁর শরীরে। উফফ এ এক অনাবিল অনুভূতি। যা ভোলা সম্ভবনা তারপক্ষে। দু চোখ বন্ধ করে সে তাঁর সর্বাঙ্গে অনুভব করেছিল বহু প্রতীক্ষিত এই দুর্যোগকে। এ যেন এক অপার্থিব অনুভূতি। বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝে দুটি নির্জন নিঃসঙ্গ দ্বীপ মিলিত হয়ে তৈরি করল এক মহাদেশ। দুইটি ভিন্ন প্রজাতির নিঃসঙ্গ জীব বৈচিত্র মিলিত হয়ে মেতে উঠল মহোল্লাসে। বিহুর শুষ্ক দুটি ঠোঁটের শেষ প্রান্ত থেকে তাঁর বুক পর্যন্ত বিস্তৃত মরু প্রান্তের ধূসর বালুরাসির মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছি এক অমৃত ধারা।বহুদিন পর এক পুরুষালি গন্ধে সবুজ হয়ে উঠল দীর্ঘ মরুপ্রান্তর। কয়েক হাজার বছর ধরে সে যেন পথে চেয়ে বসে আছে সেই মুহুর্তটুকুর প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায়। কতবার যে তা তাঁর জীবনে ফিরে এসেছে, কতরূপে তা আজ আর মনে নেই তার। বিহু অনুভব করল জগদীশ তার ডান হাত ধরে বসে বসে খাচ্ছে। আর সে বাঁ হাত দিয়ে খাবার পরিবেশন করছে। পরোটা আর চিলি পনির খেতে খেতে জগদীশ তাকিয়েছিল তার দিকে। বহু প্রতীক্ষিত সে চূড়ান্ত মুহুর্তে শামুকের মতন নিজের খোলশের মধ্যে গুটিয়ে গেছিল বিহু।
বিহু ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে পালঙ্কের দিকে। তার কমলা আঁচল উড়ছে হাওয়াতে। খাবার টেবিল থেকে তার পালঙ্কের পথের দুই ধারে লাল গোলাপ ফুটে আছে। সেই গোলাপের সুগন্ধ সে পাচ্ছে, চারদিকে হাল্কা সাদা কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে। জগদীশ বিহুর আঁচল ধরে সেই আঁচলের গন্ধ নিচ্ছে। বিহু থমকে দাঁড়িয়ে আছে পালঙ্কের সামনে। ঘরের মধ্যে হাল্কা প্রদীপের আলো জ্বলছে, আর লাল গোলাপের শয্যায় তার সাথে নাগরাজের মিলন হচ্ছে। বিহুর লম্বা কালো চুল এক একটি নাগের রূপ ধারণ করে পালঙ্কের চারধার দিয়ে নৃত্য করে চলেছে।
একটা দমকা হাওয়া বিহুর মুখে এসে লাগল। তার এক ঢাক কোঁকড়া চুল গুলো বিষাক্ত নাগের মতন কিলবিল করে উঠল যেন। সে দেখতে পেল দূরের মাঠের মাঝে দুটি সাপের শঙ্খ লেখেছে। এক মাঝবয়সী মহিলা গিয়ে যুগল সাপের গায়ে গামছা মেলে দিল। ভদ্রমহিলাকে খুব পরিচিত মনে হল তার। জানালার সামনে মুখ এনে বিহু দেখল ভদ্রমহিলা আর কেউ না তার শাশুড়ি। খওলা মাঠের ওপরের নীল আকাশ দিয়ে একটা বিদেশী বিমান উড়ে গেল। জগদীশ কয়েক হাজার মাইল দূরে যাত্রা শুরু করল। 

Comments
Post a Comment