আমি একটি মেয়ে

আমি একটি  মেয়ে
—————
—————

দেবশ্রী চক্রবর্তী 


কিছু ঘটনা নিজে থেকেই ঘটে যায়, কোন যুক্তি তর্ক দিয়ে যাকে ব্যাখ্যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। যেমন একটু আগে চলন্ত ট্রেনের দরজা কিভাবে খুলে গেলো ছেলেটি বুঝে উঠতে পারল না। ক্ষুদার্ত মানুষের পক্ষে বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে সব কিছু বিচার করাও সম্ভবনা। দরজাটা খুলে যেতেই অপরিচিত মানুষটি এসে মুখোমুখি বসলেন।কিছুক্ষণ একভাবে বসে থাকারপর  দীর্ঘক্ষন চলন্ত ট্রেনে ঝুলে আসার ক্লান্তি কাটাতে কামরার দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমোতে লাগলেন লোকটি বেশিক্ষণ তাকায়নি।সেই কারণে তাঁর চোখের ভাষা অধরাই থেকে গেছে। অক্ষর সংলাপহীন পাতায় বেশিক্ষণ চোখ রাখলে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, ট্রেনটি এক জায়গায় থেমে থাকায় তাঁর দাঁড়াতে সমস্যা হলনা। সে এগিয়ে গেল খোলা দরজার ধারে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর ঠাণ্ডা হাওয়া কামরার ভেতরে ঢুকতেই দমবন্ধকরা গুমোট ভাবটা বেড়িয়ে এসে ছুটে গেলো নদীর ধারের মৃত চটকলের চিমনীর দিকে, তাঁদের অতীত রোমন্থন করোতে। মাঝেমাঝে অতীতে ফিরে যেতে সত্যি খুব ভালো লাগে। ধানের ক্ষেতের মাঝে জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে চোখ ফিরিয়ে সে তাকিয়ে দেখল সামনের রেললাইনের দিকে। দুটি লাইনের মাঝখান থেকে উজ্জ্বল দুটি বিষাদময় নক্ষত্র যেন তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ভয়ংকর উজ্জ্বল তাঁদের উপস্থিতি। ছেলেটির নেশাই তো চোখের ভাষা পড়ে নতুনকে আবিষ্কার করা। সে জানে ট্রেন ছাড়তে এখনো বহু দেড়ি, তাই সে দরজার সামনে পা ঝুলিয়ে বসে পড়া শুরু করল  বিষাদময় সেই কাব্য। এত আলো , যেন কোন উজ্জ্বল সকাল ঝলমল করছে রাস্তাঘাট।মনে হচ্ছে যেন কোন হাট বার। রাস্তার দুই ধারে বাজার বসেছে। দোকানীরা হাঁক দিচ্ছে আর ক্রেতাদের জনারণ্যের মাঝে একটি লোক নীরবে ঝোলা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই পথে। লোকটির চোখ বড় বেশি নীরব, যেন মনের সব কটা দরজা বন্ধ করে সে পথে বেরিয়েছে। কিছু দূর যাবার পর মাছের বাজারের সামনে এসে লোকটি নাকে রুমাল দিলো। তারপর ডান দিকে মাছের বাজারের পেছনের রাস্তার এক দিকে ব্যাগটা রেখে সে নীরবে মিলিয়ে গেলো পচা ঝিলের বাঁদিকের সরু পথ দিয়ে।সেখানে কাঁচি চালিয়ে একটি চিত্র বিচ্ছিহ্ন করে দিয়ে আরেকটি চিত্র নতুন শুরু হল। কিছুক্ষণ মাছের নাড়িভুঁড়ি আর আঁশের মাঝে পরে থাকার পর ব্যাগটি যেন তাঁর শরীরে প্রাণ ফিরে পেল। সে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে উঠল। তারপর এক সদ্যজাতের চীৎকার। জনারণ্যের কোলাহলের মাঝে সদ্যজাতের আর্তনাদ হারিয়ে গেলেও গোটা ছয়েক ক্ষুদার্থ বালক খাবারের সন্ধানে তুলে নেয় সেই ব্যাগটিকে। সারাদিন সদ্যজাতের কান্না ভাঙ্গিয়ে চলে ভিক্ষাবৃত্তি, রাতে এক গাছের ডালে সেই ঝোলা ঝুলিয়ে তাঁরা ছুটে যায় নেশার ঠেকে। নেশাতুর চোখে তাঁরা তাকিয়ে থাকে গাছের ডালের দিকে, একদিন থোক থোক ফুলে ভরে যাবে সেই ডাল আর প্রানভরে তাঁরা সেই গন্ধের নেশায় মেতে থাকবে। অন্ধকারে শূন্যে ভাসমান হাজার হাজার কাগজের টাকার হিসেব করোতে করোতে তাঁরা কাটিয়ে দেয় সাতটি বছর। মেয়েটি বেরিয়ে এসেছে সেই ঝোলা থেকে, আজ সে ভিক্ষা করে পথে পথে। এই পথ তাঁকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সেদিন এক পানওয়ালা দাদুর কাছে হাত পাততেই সে মুখ থেকে তাঁর এঁটো বিঁড়ি এগিয়ে দিয়ে টান দিতে বলে। মেয়েটি দুবার টান দিয়ে তাঁর কোচি ঠোঁটের ডগা দিয়ে যখন ধোঁয়া ছাড়ে , দাদু এগিয়ে এসে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে তাঁর ঠোঁটে। সাত বছরের শিশু কন্যার মুখ ভরে যায় সত্তর উর্ধ এক বৃদ্ধের দুর্গন্ধময় কামুক লালায়। তারপর এইভাবে দান প্রতিদানে ক্লান্ত মেয়েটি এক রাতে এসে আশ্রয় নেয় একও ফুটপাথে। সারাদিনের ক্লান্তিতে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় হাল্কা হয়ে আসে পার্থিব চলন্ত চিত্রপট। ফুটপাথ থেকে  ঘুমন্ত হাড়গিলে শিশুর দেহটি   চলন্ত এক গাড়ি এসে তুলে নিয়ে ছুটে যায় ,স্বপ্নের ঘোরে সে অনুভব করোতে থাকে তার জীবন দর্শন।  তারপর সেখানে একটি কুকুর একটি পাগল এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি এসে থামে আবার ছুটে চলে যায়। ভোর রাতে  আবার সে গাড়ি এসে রেখে যায় এক কঙ্কালসার শিশুর মৃতদেহ। ফুটপাথ ভেসে যায় রক্তে, সেই রক্ত রাস্তা আর  শহুরে সভ্যতার সীমারেখা পার করে এগিয়ে চলে গ্রামের পথে। শহরের নর্দমার পাকে মিশে সেই রক্ত অন্তঃশলিলা হয়ে গিয়ে মেশে নদীর স্রোতে। তারপর সেই মূল স্রোত থেকে এক শাখা  বেঁকে যায় কোন এক অজানা গ্রামের দিকে। নদীর ধারে রাস্তা দিয়ে নতুন বৌ চলেছে তাঁর শ্বশুর বাড়ির পথে। গরুর গাড়িতে সাজানো গোলাপের মালার মাঝে লজ্জাবতী বৌ আর বর পাশাপাশি। ধানক্ষেতের ধার  দিয়ে গরুর গাড়ি ছুটেছে।এই পথের ধারে যে বট গাছ তাঁর ডান দিক দিয়ে রাস্তা চলে গেছে গ্রামে। এই গ্রামের প্রথম বাড়িটা বুধুয়াদের। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গ্রামের মেয়েরা নতুন বৌকে  নিয়ে এগিয়ে চলে ভেতর বাড়ির দিকে।সামনে দুধ আর আলতা মেশানো পাত্রটি যেন গোলাপি রঙের এক দীঘি। এই দীঘি পার করেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে তার স্বপ্নের সেই আনন্দময় দিন গুলির দিকে দীঘির এপাড় থেকে পাড়ের  দূরত্ব কয়ে হাজার আলোকবর্ষ। ওপারের রঙ্গিন স্বপ্নদের দেখে সে এগিয়ে চলে। লাল,নীল নানান রঙের শাড়ি আর গয়নার ঝংকারের মাঝে কিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নতুন বৌয়ের লজ্জাবস্ত্র ভেদ করে ছুঁয়ে দেখতে চায় তাঁর সম্পূর্ন অস্তিত্ব। কিন্তু সেই কালো লোলুপতা আঘাত খায় মাটির ওপর সদ্য রক্তাক্ত পায়ের ছাপে।  শুভ কাজে ব্যাঘাত পরে। গ্রামের এক সবুজ শাড়ি তাঁর আঁচল উড়িয়ে লাল শাড়ির নতুন বৌকে নিয়ে চলে নদীর ধারে। পথ তার স্বপ্নেরা বিপরীত  মুখী প্রবাহে ক্ষত বিক্ষত হয়ে ওঠে। পথে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির জল নতুন বৌয়ের শরীরের লাল রঙ ধুইয়ে পথ রাঙিয়ে চলতে থাকে নদীর ধারে। ঘোমটার আড়ালে সে দ্যাখে সারিবদ্ধ সব ছোট ছোট মাটির ঘর। প্রবল বৃষ্টিতে ভাঙ্গা রাস্তায় গরুর গাড়ির চাকার ঘর্ষনে মেয়েটি তলপেটে এক মহা প্লাবনের ঘুর্নাবর্ত তৈরি হয়। পরিবেশ যেন আরো বেশি অন্ধকার হয়ে ওঠে। মেয়েটি অপরিচিতার সাথে মাটিতে লাল রঙের ছাপ ফেলে ঢুকে যায় এক ঘরে। সবুজ শাড়ি তাঁর আঁচল থেকে সবুজ রঙের কাপড় কেটে তা দিয়ে বেঁধে দিয়ে যায় দরজার বাঁধন। রংবেরঙের ছেঁড়া কাপড় গুলো এক একটি মৃত স্বপ্নের মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে মাটির মেঝের খাঁজে। তলপেটের প্রবল যন্ত্রণায় মেয়েটি খামচে ধরে মাটির মেঝে। তারপর সেখান থেকে দলা দলা মাটি তুলে ছুঁড়ে মারে সেই সব রঙ্গিন স্বপ্নদের দিকে। কবরস্ত স্বপ্নেরা জীবাষ্মে পরিণত হয় মাটির গভীরে। কয়েক ঘণ্টায় যেন মেয়েটি পার করে ফেলেছে কয়েক হাজার বছর। বৃষ্টির আওয়াজ আজ তাঁর কাছে বিয়ের সানাইয়ের মতন বিষাদময়। তাঁর সিঁথির সিঁদুরের রক্তিম ধারায় সে এগিয়ে ভেসে চলেছে এক নিরাশার লোহিত সাগরে ভাসমান কোন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপে। প্রদীপের আলোয়  অন্ধকার এই ঘরে মেয়েটির দীর্ঘ ছায়া মাটির দেওয়ালে। আজ সে অনেক বেশি পরিণত। নিজেকে এক দেবী বলে মনে হয় যেন। মন্দিরের দেওয়ালে যেমন সিঁদুরের দাগ থাকে, এই মাসিক ঘরের দেওয়ালের প্রতিটি কোনায় লেগে আছে রক্তের দাগ। আঙ্গুল দিয়ে লিখে চলা এক নীরব প্রদিবাদের পটচিত্র। কত নারীর দীর্ঘশ্বাস আর হতাশার নীরব কান্না প্রতিফলিত হচ্ছে এই চারদেওয়ালের মাঝে। মেয়েটি তাকিয়ে আছে সেই দিকে, যেখানে আঙ্গুলের ডগায় রক্ত এঁকে চলেছে তাঁর আত্ম কথা। মেয়েটিরও খুব ইচ্ছে করল সেও কিছু লিখবে , না ছিটে ফোঁটা দাগ সে দেবে না, সে সবার আত্মকথাকে মুছে দিয়ে লিখবে নিজের আর্তনাদের ইতিবৃত্ত। নিজের শরীর থেকে শাড়ি খুলে সেই শাড়ি দিয়ে সে দেওয়াল মুছতে লাগল। দেওয়ালে লেগেথাকা সব দাগ ঢেকে গেল লাল রঙে। প্রদীপের পেছনের দেওয়ালের লাল রং আরো গাঢ় হয়ে উঠল মাঝ রাতে, যখন দরজার পেছন থেকে সবুজ কাপড়ে টান লাগল। বেড়ার দরজার খটখট শব্দ মেয়েটি কুঁকড়ে বসে আছে ঘরের এক কোনে। তাঁর দুপায়ের মাঝখান দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে মেঝের ওপর দিয়ে। সবুজ দড়ি উড়ে এসে পড়ল লাল রঙের ওপর। তারপর বেড়ার দরজা খুলে চারটি পায়ের ছাপ এসে পড়ল লাল মেঝের ওপর। 


উজ্জ্বল বিষাদময় দুটি নক্ষত্র লোকের থেকে বেড়িয়ে ছেলেটির মনে হয় দেহহীন মুণ্ডটি যেন এক ব্রহ্মাণ্ড, সেই নীরব ব্রহ্মাণ্ড প্রদক্ষিণ করার পর ছেলেটি অনুভব করে তাঁর সারা শরীর ভিজে গেছে, সে তাকিয়ে দ্যাখে গাঢ় রক্ত শৌচাগার থেকে বেড়িয়ে ট্রেনলাইনের ওপর এসে পড়ছে। এখন এই ট্রেনের কামড়াটি ঠিক যেন সেই মাসিক গৃহে পরিণত হয়েছে। মাথাটি পরে আছে রেল লাইনে।ট্রেনটি আবার চলা শুরু করে, শৌচাগারের দরজাটা খোলা আছে, তাই এত আওয়াজ হচ্ছে। দরজাটা এখুনি দিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে ঘুমন্ত যাত্রীদের অসুবিধা হবে। ছেলেটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে শৌচাগারের দিকে। দরজার সামনে রক্ত জমে আছে। মনে হচ্ছে শৌচাগার থেকে রক্তের নালা বয়ে আসছে। দরজার আঘাতে রক্তের ছিটে এসে লাগছে ছেলেটির শরীরে। সে দরজাটা খুলে তাকিয়ে দ্যাখে মাথাহীন এক নারীর শরীর, যার যোনি পথ রক্তবাহী এক নালা। ছেলেটি দরজা বন্ধকরে দেয়। তারপর সে পেছন ফিরে দ্যাখে সেই অপরিচিত যাত্রী তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। যার দুটি চোখের মাঝে জেগে আছে মাছের বাজারের পেছনের পচা ঝিলের পাশের সরু পথের চিত্র। ছেলেটি তাকিয়ে দ্যাখে মেঝের ওপর রক্তাক্ত চারটি পায়ের ছাপ। সে কানপাতে শৌচাগারের দেওয়ালে। সেখানে সে শুনতে পায় এক নারী এবং এক সদ্যজাত শিশুর কান্না। শৌচাগারের দরজা ভেদ করে এক নারী এক সদ্যজাত শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চলে দরজার দিকে। ছেলেটি তাঁদের ধরার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। দুজন অশরীরী ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে চলে নদীরধারের মাসিক ঘরের দিকে , দেওয়ালে আঁকা এক অর্ধবৃত্তকে পূর্নতা দিতে। 



Comments

Popular Posts