যশোর রোডের গাছেদের কথা

যশোর রোডের গাছেদের কথা 

দেবশ্রী চক্রবর্তী 

তখন বেশ রাত, কটা বাজে আজ আর মনে নেই। তবে সেদিন পূর্নিমা ছিল মনে আছে। আমার সামনের চিত্রপট কালো আর হলুদ আলপনায় বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি দেবী বহু মূল্যবান মণি মাণিক্যের অলঙ্কারে সেজে তিলোত্তমা হয়ে উঠেছেন। ইচ্ছে করেই গাড়ির কাঁচ নামাতেই একটা ঠাণ্ডা হাওয়া গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই আমার মানসিকতার এক অদ্ভুত পরিবর্তন হল। মনে হল আমি আদিমতায় ফিরে গেছি। গাড়িটা রাস্তার এক প্রান্তে দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। চারিদিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে আসছে। আমি চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, মনে হল কোন গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছি। মনে মনে ভাবলাম আমি কি পথ হারিয়েছি। কিন্তু আমার গাড়ির নেভিগেটর তো বলছে আমি ঠিক পথেই চলেছি। আর দু কিলোমিটার সোজা গিয়ে ডান দিকে টান নিলেই একটা ৫০০ বছরের পুরানো বট গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তা বেঁকে গেছে সেখান থেকেই বকুলদের  গ্রামের  রাস্তা শুরু।আমি চলেছি আমার বন্ধু বকুলের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।  আমি ভালো করে আবার নেভিগেটরটা দেখে মনে মনে বললাম, হ্যাঁ ঠিকইই তো আছে যশোর রোড। আমি এই মুহুর্তে যশোর রোডে আছি। 

আমি যশোর রোডে  আছি, মনে হতেই আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হট করে এরকম মন খারাপ আমার মাঝে মধ্যেই হয়, তবে সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল আমার চারপাশে কেউ বা কারা আমার সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছেন। আমি নিজে প্যারা সাইকোলজির ছাত্রী, তাই এই ধরনের টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ নিয়ে দীর্ঘ দিন পড়াশুনা করতে হয়েছে। ঝিঁঝিঁ  পোকার ডাক হঠাৎ যেন  কান্নার  মতন শোনাল। মনে হচ্ছে এক সাথে অনেকে একটানা কেঁদে চলেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি এতক্ষণ ধরে যাকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভাবছিলাম, তা আমার মনের ভুল ছিল। আমি নিজের অজান্তে মনুষ্যবর্জিত জগতে প্রবেশ করে ফেলেছিল। জানিনা কতক্ষণ এইভাবে বসেছিলাম, আমার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আর কোন ইচ্ছা ছিল না। কালো পিচের রাস্তার ওপর গাছের  ছায়া এবং চাঁদের আলোয় এক অদ্ভুত আলপনা তৈরি হয়েছিল। কালো পাথরের ওপর সোনার ছিটে ছিটে কারুকার্য দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল। হলুদ রঙের বিন্দু গুলো বেশ উজ্জ্বল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল কারুর মূল্যবান চোখের জল সোনার রূপ নিয়ে বিছিয়ে আছে রাস্তার ওপর। রাত বারার সাথে সাথে কান্নার আওয়াজ যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল। আমি এবার গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম যশোর রোডে। 

রাস্তার দুই ধারে সারি বদ্ধ একদল প্রবীণ দাঁড়িয়ে আছেন। বয়সের ভারে এক ফোটা না ঝুঁকেই এঁকে ওপরের বাহু শক্ত করে ধরে তারা অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন।তাদের চোখের জলের ফোটাই পরে আছে রাস্তা জুড়ে। আমি আমার মাথার ওপরে তাকিয়ে দেখলাম তাদের শতপোক্ত বাহু এঁকে অপরকে বেষ্টন করে একটা ছাদের মতন তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে তারা এই রাস্তা এবং তার পথিকদের আগলে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু আজ আমি তাদের কান্না এবং দু চোখে এক ভয়ঙ্কর আকুতি দেখতে পেলাম। তারা যেন আর্তনাদ করে বলছেন আমরা তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি। তবে কেন আমাদের মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হল? মানুষকে অক্সিজেন দিয়েছি, আজন্ম ছায়া দিয়েছি, তবে কেন আজ এত বড় শাস্তি পেতে হল? 

আমি সত্যিই গাছেদের কথা বুঝতে পারছিলাম কোন ভাবে ওরা আমার মনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে নিজেদের কথা পৌঁছে দিতে পেরেছে। আরেকটু মন সংযোগ করার জন্য আমি রাস্তার ধার দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। উপমহাদেশের এক পরিচিত নাম যশোর রোড, এক ঐতিহাসিক সড়ক, যার মাঝখান দিয়ে আমি হেঁটে চলেছিল। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে এই সড়ক। শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে, যা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কলকাতায় গিয়ে মিশেছে। আমি অনুভব করছিলাম যশোর রোডের প্রতিটি  কোনায়  কত কাহিনি, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে ।আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে একটি গাছকে প্রথম স্স্পর্শ করলাম, এত রাতে যতি চাঁদের আলও থাক, বোঝা যায়না এটা কোন গাছ। তবে তাকে স্স্পর্শ  করার সাথে সাথে সে  আমার মনে বার্তা পাঠাল, সে বলল,  মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস।আমি তার গায়ে হাল্কা  করে হাত বুলিয়ে দিতে তার মনের কষ্ট যেন একটু কম হল, সে কিছুটা আরাম বোধ করে বলল,  এই রোড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন।সে তার ডাল পালা ঝাপটে বলল,  এই রোডের পাশে কত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল। এই রোড দিয়ে ঘুরেছেন অনেক নেতা, কবি-সাহিত্যিকেরা।আমরা দীর্ঘ দিন ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেই যশোর রোডের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গৌরব আজও উজ্জ্বল। এখন যশোর রোড চওড়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সড়কের মর্যাদা পেয়েছে। এ তো আনন্দের কথা। কিন্তু নগরায়নের জন্য আমাদের কেন হত্যা করা হচ্ছে? আমাদের হত্যা করলে এই পৃকৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা কি কেউ বুঝতে পারছে না। আমরা না থাকলে অক্সিজেন কে দেবে? ছায়া কে দেবে?ভূমিকে শক্ত করে কে ধরে রাখবে? অক্সিজেনের অভাব আর প্রাকৃতিক দূর্যোগে যে তোমাদের সভ্যতাই ধ্বংস হয়ে যাবে। 

বাকি  সব গাছ গুলো একসাথে যেন ডাল পালা ঝাপটে সমর্থন জানাল। অনেকটা আমাদের করতালি দেবার মতন। তারা একসাথে বলল, পরিবেশ বাঁচাতে তাদেরও বাঁচাতে হবে; ইতিহাস মুছে নয়, ইতিহাস রক্ষা করে।আমরা বেঁচে থাকলেই তো তোমরা বাঁচতে পারবে। আমাদের বাঁচিয়ে এমন এক কায়দায় রাস্তা তৈরি করো, যাতে আমরা রক্ষা পাই। 

আমার মনে হল সীমান্তের ওপার থেকে কেউ কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি আরো একটু মন সংযোগ করার জন্য এবার রাস্তার মাঝে চোখ বন্ধ করে বসে পরলাম। প্রথমেই বলেছি এ এক অদ্ভুত জগত। মানুষরা এখানে আসে না, আমি ভুল করে ঢুকে পড়েছই। তাই রাস্তার মাঝে যানবাহনের ঝামেলা নেই। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পরিষ্কার শুনতে পেলাম কাঁটাতারের ওপার থেকে কারা যেন বলছেন একাত্তরে এই যশোর রোডের আশপাশের সেই চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর, গোবরডাঙ্গা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা আর অশোকনগরে বাংলাদেশিদের ঠাঁই হয়েছিল সড়কের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে একাত্তর সালে লিখেছিলেন কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এই যশোর রোড দিয়েই একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত করতে গিয়েছিলেন অস্থায়ী বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। সেই যশোর রোড আজও ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

এবার যশোর রোডের ইতিহাস জানতে একটু পেছনের দিকে ফেরা যাক। সম্রাট শের শাহ্ ১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সোনারগাঁ থেকে আজকের পাকিস্তান পর্যন্ত তৈরি করেন গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা ছুঁয়ে লাহোর-পেশোয়ার অবধি চলে গেছে এই রোড। আবার ইংরেজদের বাংলা দখলের আগে সংস্কারের অভাবে এই রোড মেঠো পথে পরিণত হয়। তখন দস্যু-তস্করের হামলার ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই পথ দিয়ে চলাচল করতেন রাজকর্মচারী ব্যবসায়ীরা। তখন যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। যশোর জেলা হওয়ার পর এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। তখন যশোরে গড়ে ওঠা উচ্চ মধ্য শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদের কাছে গঙ্গাস্নান পুণ্যের কাজ। সেই সময় যশোর থেকে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন। আবার কেউ কেউ পালকিযোগেও যেতেন। যেতেন বনগাঁ হয়ে চাকদহের গঙ্গার ঘাটে। যশোর থেকে চাকদহের দূরত্ব ছিল ৮০ কিলোমিটার।

সে সময় যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। উদ্বিগ্ন পুত্র দরজা খোলার অনুরোধ জানালে মা শর্ত দেন, গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। ফলে এই রাস্তাকে অনেকে কালী বাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করেন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর অকল্যান্ড এই সড়ক নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন, যার নির্মাণকাজ ১৮৪৫ সালে শেষ হয়। আর তখন এই সড়কের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের সেদিন রাস্তার দুই ধারে লাগানো হয়েছিল। আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে সময় এবং স্থানীয় মানুষজনের সাথে আমরা একাত্ম হয়ে উঠি। 

কথা বলতে বলতে তাদের কান্না যেন অনেকটা কমে এলো। এক বৃদ্ধ গাছ আমাকে রাস্তার ওপার থেকে বলল, তুমি তো বকুলদের গ্রামে যাচ্ছ, বকুলের ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করো, ও তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, তার ঠিক পেছনের গ্রামের মেয়ে। বিয়ের আগে ও রোজ আমার সারা গায়ে ঘুটে দিতে আসত। আমার গায়ে ঘুটে না দিয়ে যে ওর ঘুটে ঠিক তৈরি হত না। 


খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গল। আমি রাস্তার একধারে আমার গাড়ির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলাম। ভোরে পাখির ডাক চারপাশ থেকে ভেসে আসছে। মাঠের পূর্ব দিকে সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে সূর্যদয় হচ্ছে। এতক্ষণ এখানে বসে কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম না বাস্তব তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ধীরে ধীরে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালাম যশোর রোডের গাছেদের দিকে। তাদের বুকের মাঝে খোদাইকরা নম্বর গুলোকে দূর থেকে দগদগে ঘায়ের  মতন লাগল। মনে  হল বুকের মাঝখানটা ফুঁপিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছেণ ওরা। আমি বট গাছের পাশ দিয়ে বাঁক নিলাম বকুলদের গ্রামের দিকে, দূর থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে এলো। আমার মনে হল গাছেদের আর্তনাদ শোনা গেল। 

Comments

Popular Posts