ক্যানভাস 

দেবশ্রী চক্রবর্তী 

পূর্ণিমার রাতে প্রকৃতি যে এক অনন্য শোভায় আবৃতা হয়ে মায়াময়ীর রূপ ধারণ করে তা আজ রাতের এই পথ চলা না থাকলে বোধহয় আজীবন অজানাই থেকেই যেত। এ এক অদ্ভুত নেশা, নিজেকে মাঝে মধ্যে নেশাগ্রস্থ বলে মনে হয়। যাক এরকম একটু নেশা গ্রস্ত থাকা ভালো। নাহলে জীবনের চলার আনন্দটা বড় বেশী বিস্বাদ হয়ে যায়। চাঁদের আলোয় দূরের পাহাড়ের খাজে দাঁড়িয়ে থাকা বন জঙ্গল আর মানুষের ঘরবাড়ি সব কিছু বড় বেশী পরিষ্কার দেখা যায়, যা দিনের বেলায় সূর্যের কড়া রোদেও দেখা সম্ভব না। এত উজ্জ্বল আলো পছন্দও না জিম সাহেবের। রাতের আলো অনেক বেশী সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন।ঐ তো ঘন সবুজ পাহাড়ের মাঝে একটা ঝরনা। অত দূর থেকে ঝর্নার আওয়াজটাও কানে আসছে। ঝরো হাওয়ায় দূর দূরান্তের আওয়াজও পরিষ্কার শোনা যায়। ঝর্নার সাথে ক্ষেতের মাঝখান থেকে একটা চাপ বাঁধা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলে এক আবহ সংগীত রচনা করেছে। সামনের ক্যানভাসটা সংগীতময় একটি চলমান চিত্র, আলোর এবং হাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে চিত্রপটের এক অদ্ভুত পরিবর্তন হচ্ছে। চাঁদের ক্রমশ স্থান পরিবর্তনের জন্য আলোর পরিবর্তন হচ্ছে এবং হাওয়ার দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে শস্য ক্ষেতের মাঝে যে ঢেউ উঠেছে সেও ইচ্ছেমত পরিবর্তিত হচ্ছে।  এই পরিবর্তনটাই যদি ক্যানভাসে তুলে ধরা যায় তাহলে ভ্যান গগের ঘরানার একটা থ্রিডি পেন্টিং তৈরি হবে। এ তো তার বহু দিনের স্বপ্ন। কিন্তু সেই ধারার কোন চিত্রপট আজ পর্যন্ত সে খুঁজে পায়নি। তবে এখন মনে হয় তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবার সময় এসেছে।  
 
রাস্তার দুই ধারে ক্ষেত, মাঝে মাটির রাস্তা, আর চারদিক উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই পথে আজ সকালেই প্রথম আসা। কিন্তু তখন এত সুন্দর লাগেনি এই প্রকৃতি।দিনের বেলায় এত আলো থাকে, তাছাড়া সেইভাবে হাওয়াও বয় না, তাই হয় তো সে কিছু অনুভব করতে পারেনি। তবে প্রায় আধ ঘণ্টা একটানা পথ চলার ক্লান্তি তারপর পিঠে ভাঁড়ি ব্যাগ, সাহেব হাঁটুর ওপর ভড় দিয়ে কিছুক্ষণ হাফয়ে নিলেন। একটু কোথাও বসে জিরিয়ে নিলে ভালো হয়। হাঁটুর ওপর দুই হাত দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁফানোর পর তার মনে হল ডানদিক থেকে একটা আওয়াজ এলো, আওয়াজটা খুব তীব্র, তার সাথে সাথে ভয়ঙ্কর আলোর ছটা। সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ডানদিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা জ্বলন্ত বাড়ি, বাড়িটার থেকে আগুন ঢেউয়ের মতন ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সেই ঢেউ ছুটে আসছে সাহেবের দিকে। কোন কিছু না ভেবে সে সামনের দিকে ছুটতে থাকল, কিছু দূর যাবার পর যখন মনে হল সে বিপদ সীমার বাইরে বেড়িয়ে এসেছে, আলোর ছটাও কমে এসেছে তখন সে দাঁড়াল। তারপর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল দাউ দাউ করে জ্বলছে।

সাহেব একটা বটগাছের নীচে হেলান দিয়ে বসে, তার এমারজেন্সি লাইট জ্বালিয়ে ক্যানভাসে সেই চিত্র আঁকা শুরু করলেন। তার ব্যাগের ভেতর প্রয়োজনীয় জিনিশ পত্রের মধ্যে অন্যতম এই আলোটি। কারণ ঐযে আগেই বলেছি নেশা, কোথায় কখন নেশা ওঠে তা কি আর বলা যায়? তখন সেখানেই তো বসে পড়তে হবে। এই আলোটির আসার আগে তিনি নিজের দোষে বহু ভালো সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। সাহেব ছবি আঁকছেন, আগুন আর প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ছবিটিরও পরিবর্তন হতে থাকল। নেশাগ্রস্থ মানুষরা এরকমই হয়, স্থান,কাল কোন কিছুর কথা না ভেবে তারা নেশা করতে বসে পরে। এই সাহেবের নেশা ছবি আঁকা। প্রায় দু মাস ধরে তিনি মণ্ডল পট্টিতে আছেন এখানকার প্রকৃতি আর মন্দিরের ছবি আঁকবেন বলে। আজ ভোরে সে খবর পায় ভেঙ্কটেশ স্বামী মন্দিরে একজন প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো কিছু ছবি বিক্রি করতে চান। সাহেব সেই ছবির নেশায় সকালে মন্দিরে গেছিলেন। ফেরার সময় অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় তিনি কোন যানবাহন না পেয়ে হাঁটা পথে ফিরছেন। তারপর এই অবস্থা। সাহেব সামনের দিকে দেখছেন আর ক্যানভাসে রঙ দিয়ে চলেছেন। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো মনে নেই। কিন্তু ভোরের দিকে যখন আগুন নিভে গেলো, তখন তিনি ধোঁয়া ওঠা ক্ষেতের মাঝে একটি ছেলেকে দেখতে পেলেন। প্রথম প্রথম কাক তাড়ুয়া ভেবেছিল, কিন্তু ছেলেটা যখন তার সামনে এসে দাঁড়াল তখন তিনি অবাক হয়ে চেয়ে দেখলেন। ছেলেটি কাঁদছে। 

বয়েস চার কি পাঁচ হবে। চেহারা ছবি দেখে স্থানীয় আদিবাসী পরিবারের বাচ্চা মনে হয়। ভোরবেলা ছেলেটির মধ্যে তিনি গোটা ভারতবর্ষকে দেখতে পেলেন। খুধা আর নিরক্ষরতায় জর্জরিত এক মানব শিশু। অনেক ক্ষণ বসে বসে ভাবলেন এর আর একটি পশুর মধ্যে কি পার্থক্য আছে। একটি পশুর খুধা আছে, এরও আছে। একটি পশু নিরক্ষর,অবুঝ, এই শিশুটিও তাই। সাহেব পাগল মানুষ। তিনি ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। ছেলেটিকে পেয়ে তিনি হাতে চাঁদ পেলেন। জ্বলন্ত শস্য ক্ষেতের সামনে ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে সাহেব ছবি আঁকা শুরু করলেন।তিনি জানেন যে, এই ধরনের ছবি এর আগে আর কোন দিন কেউ আকেনি। বিদেশের বাজারে এরকম ছবিরই তো চাহিদা সব থেকে বেশী।

ছেলেটা কেঁদেই চলেছে। তার কান্না আর কিছুতেই থামে না। তবে এ কান্না নীরব কান্না, শুধু চোখ থেকে জল ঝরে, মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়না। সাহেব পাগল মানুষ, তিনি অত কিছু বোঝেন না। তবে ছবি আঁকা শেষ হলে সাহেব ছেলেটিকে সঙ্গে করে চললেন গ্রামের পথে। মন্ডলপট্টি বাজারের মুখে বিশাল বড় চার্চ। এই অঞ্চলে এসে এই চার্চের ফাদারের সাথে সাহেবের সবার আগে পরিচয় হয়। সাহেব ফাদারের বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন। এই ছবি আঁকার সূত্রে দুজনের মধ্যে এক নীরব বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছে, তার আভাষ এই অঞ্চলের সব মানুষের কাছে স্পষ্ট। 

সেদিন বাজারে ঢুকে ফাদারের সাথে দেখা হয় সাহেবের। জিম সাহেবের সাথে ছেলেটিকে দেখে ফাদারের মুখের চেহারা ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়। তিনি সাহেবকে বলেন'
-আপনি কোথায় পেলেন একে?
-ভেঙ্কটেশ স্বামী মন্দিরে গেছিলাম, ফেরার পথে একে পেয়ে গেলাম ক্ষেতের মাঝে।
-ও জিজাস, রক্ষা করো প্রভু, রক্ষা করো। 
কথাটা বলেই ফাদার যে পথে সাহেব এসেছেন সেই পথে রওনা দিলেন। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন , 

 leave him.....leave him.....

সাহেব ফাদারের কথা মতন ছেলেটিকে রাস্তায় রেখে বাড়ি ফিরে এলেন। খাম খেয়ালি মানুষ হলে যা হয়, বাড়ি ফিরে একপ্রকার ছেলেটির কথা তিনি ভুলেও গেলেন। 

সন্ধ্যার দিকে ফায়ার প্লেসের সামনে বসে সাহেব মন্দির থেকে আনা ৫০০ বছরের পুড়ন ছবি গুলো দেখছিলেন। সাহেবের ঝোলা ছিল তার পেছনে, মনে হল একটা ছবি কম এসেছে, তিনি কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবলেন, রাস্তায় কোথাও ফেলে দেন নি তো, কিংবা গুনে নিতে ভুল করেছেন। কিন্তু না, তিনি তো গোটা দুইবার গুনে তারপর সেই ছবি নিয়েছেন, তাছাড়া গাছের নীচ থেকে ওঠার আগেও সব কিছু ভালো করে দেখে নিয়েছেন। কোথাও কিছু ছিল না। ব্যাগের ভেতরটা একবার ভালো করে দেখে নেবার জন্য তিনি পেছন ফিরতেই মনে হল কাঁচের দরজার ওপর আগুনের প্রতিবিম্ব পরেছে। তিনি ভালো করে সেই দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অন্ধকার ঘরের মাঝে কাঁচের দরজায় উজ্জ্বল আগুনের উপস্থিতি। এ আগুন অতি তীব্র। তার মাঝে এক বালকের মুখ, প্রথম একবার ভাবলেন মনের ভুল, নিছক কল্পনা। কিন্তু একি ,এতো কল্পনা না। ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একভাবে কেঁদে চলেছে। সাহেব মনে মনে ভাবলেন কিছু কিছু পশুর গুন, মানুষের মধ্যেও থাকে, যেমন এই ছেলেটি গন্ধ শুকে শুকে বাড়ি চিনে চলে এসেছে। 

সারাদিন মনে হয় কিছু খাওয়া হয়নি তার। সাহেব এক গ্লাস দুধ তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সে দুধের গ্লাস নিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। সারা ঘর অন্ধকার, শুধু ফায়ার প্লেস থেকে আগুনের আলো এসে পড়ছে চিত্রপটে। ছেলেটা এবার দুধ খাওয়া শুরু করল, কিন্তু সে কান্না কিছুতেই থামাচ্ছে না। জিম সাহেবের মনে হল, কিছু কিছু মানুষ এরকম থাকে, এটা জিনের দোষ। জিন খারাপ থাকলে চরিত্রের মধ্যে নানা রকম বিকৃতি দেখা যায়। যেমন এই ছেলেটি খালি কাঁদে। কিছু মানুষ আছে যারা হাসতে ভালো বাসে, কথা নেই বার্তা নেই কেবল হেসেই চলে। এ ছেলেটি তার ভাষা বুঝবে না, তাই এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। শুধু ওর প্রয়োজন গুলো মিটলেই হল। কিন্তু তার বদলে এই ছেলেটি তার মডেল হবে। জহুরীর চোখ সাহেবের, সে এক দেখাতেই বুঝেছে এই ছেলেটির মধ্যে এমন কিছু আছে যাকে ঠিকঠাক ক্যানভাসে তুলে ধরতে পারলে আর তাকে দ্যাখে কে। 

সাহেব সময় নষ্ট না করে ছেলেটির ছবি একে চলেন। এক একটি ছবিতে ছেলেটি এক এক রকম জায়গায় এক এক রকম পোসে বসে আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে একটাই মিল তা হচ্ছে প্রতিটি ছবিতে ছেলেটি কাঁদছে। 

সাহেব ছবি গুলির কিছু নমুনা বিদেশে পাঠালেন। এখানে মাদিকেরীতে প্রথম তার ছবির প্রদর্শনী করলেন। প্রদর্শনীর নাম দিলেন "দ্যা ক্রাইং বয়"। এক দিনের মধ্যে তার সব কটি ছবি বিক্রি হয়ে গেল। মাঝে ১৫ দিন কেটে গেলো। এক রাতে সাহেবের কাছে খবর এলো ফাদার জোসেফ তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সাহেব দেখলেন রাত ১১টা বাজে, এত রাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে। তিনি ছেলেটিকে বললেন,

-আমি বরং কাল সকালে যাই।

ছেলেটি মাথা চুলকে বলল,

-বিশেষ দরকার, তাই উনি এখন ডেকে পাঠিয়েছেন। 

সাহেব যাবার সময় দেখলেন বাচ্চাটি ঘুমচ্ছে, তিনি ওকে আর না ডেকে দরজা বাইরে থেকে ছিটকানি লাগিয়ে চললেন । সবে বোধয় বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে, একটা আওয়াজ শুনতে পেলেন, পেছনে তাকিয়ে আবার সেই এক দৃশ্য দেখলেন, যা সেই শস্য ক্ষেতে তিনি দেখেছেন।  তার বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, সেই ছেলেটি যে ওনাকে ডাকতে এসেছিলেন তার দেখা আর তিনি পেলেন না। সাহেব আর দাঁড়িয়ে না থেকে চার্চে ছুটে এসে জানতে পারলেন ফাদার তাকে ডেকে পাঠান নি। তিনি সময় অপচয় না করে ফাদারের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে দমকলকে ডেকে পাঠালেন। মাদিকারী থেকে দমকল আসতে প্রায় একঘণ্টা সময় লাগল। এর মধ্যে জ্বলে পুড়ে প্রায় সব শেষ।

সাহেব প্রলাপ করতে থাকলেন। তিনি শুধু বলেন, 
-হায় রে, ছেলেটা এই ভাবে পুড়ে শেষ হয়ে গেলো। 

সাহেব যত প্রলাপ করেন, ফাদার তত তাকে শান্তনা দেয়, 

-তোমাকে আগেই বলেছিলাম ওকে নিজের কাছে রেখো না। ও এক শয়তান, ও যেখানেই যাবে সেখানেই সব কিছু জ্বলে শেষ হয়ে যাবে।

সাহেবের বিশ্বাস হয় না, সে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করে। 

ভোরের আলো ছড়িয়ে পরতেই ঝাঁক ঝাঁক পাখি জংগল থেকে বেড়িয়ে ছুটে চলে দোদাবেট্টার দিকে। দোদাবেট্টার ঘন বন যে তাদের কর্মক্ষেত্র। সাহেব তাকিয়ে দেখেন সেই দিকে। হায় রে আর একটাও ক্যানভাস,তুলি অবশিষ্ট নেই যে সে এই চলমান চিত্রটিকে তুলে ধরবেন। নিজের কপালে নিজেই চাটি দিতে থাকে। এমন সময় দমকল কর্মীদের মধ্যে গোলযোগ শুরু হয়। তারা কিছু ক্যানভাস উদ্ধার করে পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে রাখেন। সাহেব নিজের কাঁধের ওপর কিছু একটা অনুভব করেন, তিনি তাকিয়ে দেখেন ফাঁদার তার কাঁধের ওপর হাত রেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন ক্যানভাস গুলোর দিকে। এই সর্বগ্রাসী আগুনেও যা পুড়ে শেষ হয়ে যায়নি। এতো এক বিস্ময়য়। দমকলের কর্মীরা জানান গত ১৫ দিনে মাদিকেরীতে পনেরোটি বাড়িতে আগুন লেগেছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, সেই প্রতিটি বাড়ি থেকেই একটি করে কান্নারত শিশুর ছবি উদ্ধার হয়েছে। সব থেকে বিস্ময়য়ের কথা , সারা বাড়ির সব কিছু পুড়ে গেলেও এই ছবি গুলির কিছু হয় নি। 

সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, 

-কোন কঙ্কাল জাতীয় কিছু কি পেলেন ? 

তারা যাবার সময় জানিয়ে গেলেন যে তারা মানুষ তো দূরে থাক কোন কিছুর কঙ্কাল খুঁজে পাননি। 

ফাঁদার বললেন,

-দেখেছ তো তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, ও একটা শয়তান, যার কোন মৃত্যু নেই। তুমি নিজে হাতে করে ওকে এখানে নিয়ে এসেছ, এখন তার খেসারৎ দাও। 

সাহেব ফাদারের কথায় কান দিলেন না, তিনি এগিয়ে চললেন ক্যানভাস গুলির দিকে। অবিকল একরকম রয়ে গেছে, এও কি সম্ভব! কি করে সম্ভব তার জানা নেই। প্রতিটি ক্যানভাস এক জিনিসে তৈরি, কিন্তু যে ক্যানভাসের ওপর এই ছেলেটির ছবি আঁকা, সেগুলো কি করে বেঁচে গেলো! এর কোন উত্তর তিনি খুঁজে পেলেন না। 

সাহেব পাগল মানুষ, বেশিক্ষণ কিছু মনে রাখতে পারেন না। তিনি জঞ্জাল সরিয়ে তার ঝোলাটা খুঁজতে লাগলেন। 

হায় রে পাঁচশ বছরের পুরানো চিত্র গুলি সব শেষে। তার এতদিনের সাধের তুলি,ক্যানভাস, রঙ যা সে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে সংগ্রহ করেছে, সব শেষ। 
ফাঁদার তার বন্ধুর হাত ধরে তাকে চার্চের দিকে যখন নিয়ে যাচ্ছেন তখন ফোনটা হঠাত বেজে উঠল। জিম সাহেব ফোন ধরে বুঝতে পারলেন ইংল্যান্ডে যেখানে তিনি ছবি গুলো পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো মননিত হয়েছে এবং তাকে পুরস্কার নেওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ মেল করে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেদিন রাত দশটায় তার ফ্লাইট। 

ফোনটা রেখে সাহেব দিগভ্রান্তের মতন ছুটতে লাগলেন। কোন দিকে তিনি তাকালেন না, তিনি তার বাড়ির সামনের দেওয়ালে রাখা ছবি গুলোর সামনে গিয়ে আগে নিজের জামা খুললেন, তারপর ছবিগুলো তার জামা দিয়ে মুছতে থাকলেন।তিনি ছবি মুছছেন আর মনে মনে ভাবছে, এত দিন ধরে যে সময়ের অপেক্ষায় তিনি ছিলেন, যে সম্মান পাওয়ার জন্য বিশ্বের তাবড় তাবড় চিত্রকররা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন সেই টুরনার পুরস্কার তার কাছে ধরা দিয়েছে এই ছবির জন্য। যে যাই বলুক এ ছবি অপয়া হতে পারে না। কথা গুলো চিন্তা করতে করতে সে একবার চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলো, কে যেন গুঙিয়ে উঠল মনে হল। না না, কেউ না, মনের ভুল , দীর্ঘ সময় মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে এরকম হয়। সে ছবি গুলো মোছার সময় বিন্দু  বিন্দু  জল অনুভব করল, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, আকাশ মেঘলা, হয় তো বৃষ্টি পড়া শুরু হল। সাহেব ক্যানভাস গুলো একসাথে গুছিয়ে নিজের মাথায় তুলে নিলেন, তারপর তিনি চলতে থাকলেন চার্চের দিকে। আজ মণ্ডল পট্টিতে তার শেষ দিন, যে কাজের জন্য তিনি এখানে এসেছিলেন, ঈশ্বর তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আগুনের মধ্যে দিয়েই তো সোনা বেড়িয়ে আসে, সেই সোনাকে তিনি বিশ্বের দরবারে তিলে ধরবেন। 

সেদিন পেটি-এম এর মাধ্যমে সাহেব কিছু পোশাক কিনলেন মণ্ডল পট্টী বাজার থেকে, তারপর বাজারের একটি হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে বারোটা নাগাদ রউনা দিলেন ব্যাঙ্গালোর বিমান বন্দরের পথে। যাবার সময় ফাদারের সাথে তার দেখা হয়নি। ফাদার কোন এক বিশেষ কারণে সেদিন মাদিকেরী গেছিলেন। ফাদারের ফিরতে রাত নয়টা বাজে। তিনি চার্চের গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার পথে দেখলেন চার্চের বারান্দায় কে যেন বোসে আছে। ফাদারের বয়স হয়েছে, চোখের সমস্যার জন্য দূরের জিনিশ সে স্পষ্ট দেখতে পান না। এত রাতে কে হতে পারে, এই চার্চে এত রাতে তিনি ছাড়া আর তো কেউ থাকেন না। তিনি কিছুটা গিয়ে এক জায়গায় থেমে দাঁড়ালেন। চার্চের পাশে রবার গাছের ডালে একটা কাল পেঁচা ডেকে উঠল। কাল পেঁচা চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গিয়ে বসল গির্জার ছাঁদে। ফাঁদার দেখলেন ছেলেটি গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। তার পাশে শোয়ানো জিমের আঁকা একটি ছবি। ফাঁদার পিছু হটতে থাকলেন, তিনি চার্চের বাইরে বেড়িয়ে যেতেই চার্চের ভেতরে একটা বিস্ফোরণ হল, গোটা চার্চ দাউদাউ করে জ্বলছে, কিন্তু ছেলেটি উধাও, কোথাও সে নেই। 

রাত নয়টা নাগাদ যখন চার্চে বিস্ফোরণ হল ঠিক সেই সময় জিম সাহেবের বিমান রউনা হল প্যারিসের পথে। একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছে জানালার দিকে প্লেনটা সবে স্টার্ট নিয়েছে, পাশের সিটটা ফাঁকা ছিল। কে যেন সিটে গিয়ে বসল। সাহেব সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। তার হাতের ওপর বিন্দু বিন্দু জল এসে পড়ছে, ছেলেটি কাঁদছে, তার হাতে একটা ক্যানভাস। সাহেব ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা রবার গাছের নীচে এক মৃত ফাদারের লাশ, পাশে একটি জ্বলন্ত গির্জা।  সাহেব একটা গো গো শব্দ পেলেন, তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া দেখতে পেলেন।ঝুঁকে দেখলেন প্লেনের চাকা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ক্রমে শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকল। তারপর একটা জোড়ে আওয়াজ , বিমানবন্দরের চারদিক আগুন নেভানোর গাড়ি ছুটে এলো। দাউদাউ করে জ্বলছে বিমান।

পরের দিন খবরের কাগজে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হল,  বিমানের বিস্ফোরণের পর সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কয়েকটি ছবি উদ্ধার করা হয়েছে যা একেবারে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। ছবি গুলিকে বিমানবন্দরের ভেতরে একটি সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছে।  

Comments

Popular Posts