মূক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের অবদান
মূক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের অবদান
দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের গর্ব। লাখ লাখ মা বোন ভাই দের জীবন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রানের স্বাধীনতা।
বাংলার বীর সেনানিদের গৌরবগাঁথা বাংলার ইতিহাস তো বটেই প্রতিটি মানুষের হৃদয়েও সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাঙালিদের পাশাপাশি
কিছু মানুষ ছিলেন যারা এই দেশের না হয়েও মানবতার টানে এই গৌরবময় জয়ে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। আজ এই বিদেশীদের কির্তিগাথা
নিয়ে কিছু কথা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রয়েছে অসামান্য অবদান ইন্দিরা নামটি শুনলেই মনে হতো তিনি মা দুর্গার মতই যেন কোন মহিয়সী দেবী, যিনি অসুরকে বধ করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন । বাস্তবেও তেমনই ছিলেন তিনি, অদম্য ইচ্ছে এবং প্রবল দাপটের সঙ্গে সকল প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও বন্ধুরতাকে একের পর এক জয় করেছিলেন, দৃঢ়চেতা ও অদম্য সাহসী ইন্দিরা তাঁর চরম মানসিক শক্তি এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ততায় সারা দুনিয়া আলোড়িত করে গিয়েছিলেন, ইতিহাস যে তাকে আয়রন লেডি বলে অভিহিত করেছে তা একেবারেই অযৌক্তিক নয়, লৌহসম দৃঢ় ব্যক্তিত্বে তিনি ভারত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তৈরি করে দিয়ে গেছেন আরেকটি দেশ, আমাদের দেশ বাংলাদেশকে ।ইতিহাস তাঁকে অমরত্ব দেবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অনবদ্য অসাধারণ এবং অনন্য ভূমিকার জন্য । অনন্য সৌন্দর্য ছিলো তাঁর মধ্যে, সেটি তাঁর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য, তাঁর রুচিবোধ, তাঁর তেজস্বিতা , তাঁর ধীরস্থির হয়ে চমৎকারভাবে কথা বলার সৌন্দর্য, তাঁর বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সৌন্দর্য । কপালের ওপর ডায়েস করা একগোছা চুল, তাঁতের শাড়ি এবং দুই ফিতার স্যান্ডেলে তাঁকে খুবই মানাতো । শীতের দেশে গেলে ওভারকোট তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতাকে চরমভাবে ফুটিয়ে তুলতো, তাঁর চালচলন, স্বভাবচরিত্র এবং ব্যক্তিত্বে ছিল চরম নান্দনিকতা । এমন ব্যক্তির প্রতি সহজেই মন শ্রদ্ধাবনত হয়ে আসে, ইচ্ছে করে পুজোর অর্ঘ ঢেলে তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।। তিনি শুধু এক কোটি বাংলাদেশীকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মার্কিন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি।
বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ভারতের বিরুদ্ধেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে সেখানেও এক হয়ে পকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে সেবাযত্ন করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যীশু খৃষ্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা। ‘তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান’ শীর্ষক একটি বইয়ে তেরেসা এ বিষয়টি উল্লেখ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সম্মাননা জানাচ্ছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মনানা ‘স্বাধীনতার সম্মাননা’ জানানো হয় তাকে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্মাননা নেন তার পুত্রবধু সোনিয়া গান্ধী।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রাতের অন্ধকারে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হাজার হাজার নারী, পুরুষ, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা করে। বিভীষিকাময় এ অবস্থায় থেকে বাঁচতে লাখ লাখ নারী-পুরুষ বাধ্য হয়ে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়।
ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন উদ্বাস্ত্তকে আশ্রয় দেন। তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সাহায্য করেন। পরম মমতায় সেদিন ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ান ও আশ্রিতদের সহায়তার জন্য ভারতবাসীকে অনুরোধ করেন।
শুধু উদ্বাস্ত্ত বা শরণার্থীদের আশ্রয়ই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবাদী অথচ নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহস জোগান তিনি। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। এর ফলেই অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হয় বাংলাদেশীদের। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে একের পর এক গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েই, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।” পরে ১৭ মে তিনি পশ্চিমবঙ্গ আসেন। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় নেয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, শরণার্থী বিষয়ে কেন্দ্র তাদের পাশে আছে ও থাকবে।
এর আগেই ৩০ এপ্রিল ’৭১ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। ৯ মে তাদের হাতে দেয়া হয় হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে আগ্রহী বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব।
এছাড়াও, শাসক পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সেসময় বিভিন্ন দেশ সফরও করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়েও সক্ষম হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সেখানে এক বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “পূর্ববঙ্গের ঘটনায় ভারতের পক্ষে উদাসীন থাকা কঠিন এবং ইতিমধ্যে ২০ লাখ শারণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এসব উদ্বাস্তু যাতে সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারে সেজন্য পাকিস্তানকে বাধ্য করতে হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের বিষয়ে অক্ষমতা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, “ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহয়তা বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই।”
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দেয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতেও আক্রমণ করে। তিনি সেদনিই তার মন্ত্রিসভার ভাষণে বলেন, “আমি এ মুহূর্তে আমাদের দেশের এবং জনগণের গুরুতর বিপদের কথা উল্লেখ করে আপনাদের উদ্দেশে বলছি, কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ করে আমাদের এয়ার ফিল্ড, অমৃতসার, পাঠান কোর্ট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উতরলেট এবং আগ্রায় আঘাত হেনেছে। এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল, তা ভারতের বিরুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’’
এর পরপরই ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী মিলিতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং পাকবাহিনী বিভিন্ন রনাঙ্গণে পরাজিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় অনেক সৈন্যও শহীদ হয়।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও অগণিত মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে।
'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ছিল বাংলাদেশের প্রধান মিত্র। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সরকারের তৎপরতা ও ভারতীয় সৈন্যদের অবদান অপরিসীম।মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা ও অফিসারদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।'২৫ মার্চের পর সারা দেশে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও নির্যাতন শুরু হলে অসংখ্য মানুষ নিরাপত্তার আশায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।তখন ভারত সরকার সীমান্তবর্তী এলাকায় শরনার্থী শিবির স্থাপন করে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।এছাড়া বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী জনমত আদায়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী,পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং,রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজ্জীবন রামের ভূমিকা অনস্বীকার্য।তাই ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার অসহায় বাঙালী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।তাদের মধ্যে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান সব ধর্মের অনুসারীই ছিল।এক কোটি শরণার্থীর লালন-পালনের জন্য ভারত সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা।এর মধ্যে মাত্র ৫০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশ ভারত ও মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য দিয়েছে।শরণার্থীদের লালন-পালন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহসহ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হয়েছে আরো বহু টাকা।সবকিছু মিলে ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে ৭০০ কোটি টাকার বেশি করেছে।ঐ সময়ে ভারতের মত একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা অর্থনৈতিকভাবে সহজ ছিল না।কিন্তু সেটি মূলত সম্ভব হয়েছিল সেসময়কার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূরদর্শীতা ও অসীম প্রজ্ঞার জন্য।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিশ্বের বড় বড় শক্তির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।বাংলাদেশের জনগণ '৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।ভারতের সহযোগিতা না পেলে হয়ত স্বাধীনতা পেতে অনেক বিলম্ব হতে পারত।
আমরা সবাই জানি যে প্রতিটা দেশের সরকার তার প্রতিরক্ষা খাতে কি বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে।তেমনি '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রায় দেড় হাজার অফিসার ও জওয়ান শহীদ হয়েছে।এর মধ্যে ৬৮ জন অফিসার,৬০ জন জুনিয়র কমিশন অফিসার এবং ১২৯৩ জন অন্যান্য স্তরের।আহত হয় ৪০৬১ জন এবং নিখোঁজ হয় ৫৬ জন ।মুক্তিযুদ্ধে একটি সহযোগী দেশ হিসেবে ভারতীয় সৈন্যদের এ আত্মত্যাগ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও এটি সত্য যে,বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে তাদের অবদান সেভাবে উঠে আসেনি।স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশীদেরআমাদের এই আত্মত্যাগ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা উচিত।আসুন,আমরা ৩০ লক্ষ বীর শহীদের পাশাপাশি শহীদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।
এবার যার কথা মনে পড়ছে তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক , উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড (ওলন্দাজ: Wiliam Ouderland)
(জন্ম:৬ই ডিসেম্বর, ১৯১৭ — মৃত্যু:১৮ই মে, ২০০১) ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করে। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী জাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
ঔডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অস্ট্রেলিয়া ঔডারল্যান্ডের পিতৃভূমি ছিল। তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। ১৭ বছর বয়সে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার
জন্য জুতা-পালিশের কাজ নিতে হয় এবং পরে তিনি বাটা স্যু কোম্পানিতে যোগ দেন। দু'বছর পর চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ডস দখলের আগে ঔডারল্যান্ড ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে নাম লেখান। পরবর্তীতে
তিনি রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত হন এবং তাঁর দলে ৩৬ জন সদস্য ছিল। তিনি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫)
অংশগ্রহণ করেন। জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার ফলশ্রুতিতে ঔডারল্যান্ডকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং জার্মানী থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজে নিযু্ক্ত হন।
ঔডারল্যান্ড জার্মান ও ডাচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্টের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন ।
ঔডারল্যান্ড ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। । কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থায়
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে দেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১-এ মার্চের গণ আন্দোলন, ২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী
সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন।
বাটা স্যু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের
পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে
থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয়
কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী,এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাঁকে 'সম্মানিত
অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের
সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এর কাছে।
তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা
প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙ্গালী যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব
রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন,
পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।
এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন।
এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের
মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ঔডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি
এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল
পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তাঁর নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭।
১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ঔডারল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তিনি বীর প্রতীক পদকের সম্মানী ১০,০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টে দান করে দেন।
একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভূষিত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি
ঔডারল্যান্ড বাংলাদেশের বাটা স্যু কোম্পানি থেকে ১৯৭৮ সালে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফেরত যান। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এডওয়ার্ড কেনেডি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার মমতা ও ভালবাসা ইতিহাসে লেখা থাকবে।১৯৭১ এ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার
জন্য লড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টি। আর তাদের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের দিকে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড।
"মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে এনেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশা নিজের
চোখে দেখে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন তিনি। "বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও এ দেশের মানুষের প্রতি মমতা ও ভালবাসা
এভাবেই প্রকাশ করে গেছেন তিনি। এটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।"তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী শিবির দেখতে, তাদের খোঁজ-খবর নিতে।
ঢাকায় কয়েকটি গণকবরে গিয়ে অকুতোভয় বীরদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।
ওই সময় এডওয়ার্ডের মন্তব্য ছিল- পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের (ইসলামাবাদ) প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন '
দুষ্কর্মে' সহযোগিতা করার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় বলেও কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্র"য়ারি ঢাকায় এসেছিলেন এডওয়ার্ড।
এখন যার কথা মনে আসছে তিনি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ - জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ - জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।করাচী থেকে প্রকাশিত দ্য মর্নিং নিউজ-এর প্রধান সংবাদদাতা এবং পরবর্তীতে সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত ছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সনের মে মাস পর্যন্ত। একাত্তর সনের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে এসে গণহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এরপর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের সানডে টাইম্স পত্রিকায় গণহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করেন। এজন্য তিনি স্বয়ং ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পত্রিকাটির ১৯৭১ সনের জুন ১৩ সংখ্যায় এ সকল তথ্যাদি প্রকাশিত হয়। এতে বিশ্ব বিবেক অনেকাংশেই জাগ্রত হয় এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে পারে। তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী অন্তরঙ্গ আলোকে প্রত্যক্ষ করে সংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে তা বর্ণনা করেছেন। তার লেখা বই হচ্ছে “দা রেইপ অব বাংলাদেশ” এবং “বাংলাদেশের রক্তের ঋণ”।
তার দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ গ্রন্থটি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। বইটির সেই প্রাথমিক সংস্করণে শেষ পংক্তিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সম্বন্ধে বলেছিলেন,
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস
আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।
“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”
প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”
রক্তের প্রথম দাগ..................
উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।
এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।
এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।
এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।
২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।
পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।
দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।
চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”।রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।
কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”
কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।
অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।
আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।
পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।
বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”
কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”
হিন্দু নিধন..................
নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।
হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”
অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”
অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”
সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।
অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।
জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................
এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।
সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)
ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।
এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।
১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।
দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।
এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।
১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।
মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................
এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।
পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।
বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।
এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।
“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।
বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।
এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।
মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।
লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।
যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।
এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।
আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................
বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।
এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।
সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।
বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।
এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।
মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।
গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।
গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।
কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।
“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”
কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।
রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।
মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।
এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।
ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।
এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।
মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।
একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।
হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................
এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।
“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।
যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।
চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।
কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
জুন ১৩, ১৯৭১
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস
আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।
“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”
প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”
রক্তের প্রথম দাগ..................
উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।
এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।
এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।
এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।
২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।
পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।
দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।
চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”। রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।
কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”
কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।
অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।
আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।
পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।
বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”
কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”
হিন্দু নিধন..................
নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।
হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”
অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”
অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”
সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।
অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।
জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................
এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।
সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)
ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।
এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।
১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।
দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।
এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।
১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।
মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................
এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।
পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।
বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।
এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।
“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।
বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।
এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।
মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।
লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।
যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।
এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।
আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................
বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।
এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।
সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।
বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।
এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।
মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।
গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।
গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।
কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।
“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”
কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।
রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।
মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।
এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।
ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।
এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।
মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।
একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।
হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................
এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।
“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।
যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।
চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।
কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
সাইমন ড্রিং (জন্মঃ ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫) একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতা। তিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক জায়গা ভ্রমণ করে তরতাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলী টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন এবং রেডিও সংবাদ ও চলতি ঘটনা তুলে ধরার লক্ষ্যে অনবরত কাজ করছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে
তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ দৈনিকে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরী করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে - হোটেল শেরাটন, বর্তমানে - হোটেল রূপসী বাংলা) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,[২]
“ আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...। ”
১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুণরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার; ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ; কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য সনি এবং হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ। তিনি একজন সেরা প্রুফ রিডারও ছিলেন
এরপর আসছেন সিডনি শ্যানবার্গের নাম । সিডনি শ্যানবার্গ ছিলেন দি নিউইয়র্ক টাইমস এর একজন সাংবাদিক। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটস এ জন্মগ্রহন করেন ।১৯৫৯ সালে তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমস এ যোগদেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চএর হত্যাকান্ড তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। সে সময় তিনি ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলের জানালা দিয়ে
তিনি দেখেন ইতিহাসের এক ভয়ানক হত্যাকান্ড । তিনি পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খন্ড খন্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী দের অবস্থা ।তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্ববাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ ।সংকলনটির নাম ডেটলাইন
বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক ।
ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল। আমি মনে করি ১৯৭১ সালের পরের প্রজন্মের এই ধরনের বইগুলো বেশি বেশি করে পড়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ভিনদেশিকে আমরা বন্ধু হিসাবে কাছে পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে কেউ সাহায্য করেছিল প্রত্যক্ষ ভাবে কেউ পরোক্ষ ভাবে। তাদেরই একজন হলেন সিডনি শ্যানবার্গ। দি নিউইয়র্ক টাইমস এর এই
সাংবাদিকের কাছে বাংলাদেশের মানুষের অনেক ঋন আছে। আমরা অবশ্যই তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ২৫শে মার্চের পাকিস্থানিদের চালানো গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী সিডনি শ্যানবার্গ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বিদেশিদের অনেকগুলো বই আছে। সবগুলো পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে যেকটি পড়েছি তারমধ্যে ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটিকে বেষ্ট মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়
শ্যানবার্গ বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন তার পেশাগত দায়িত্বের কারনে। সেই সময় করা তার রিপোর্টগুলো নিয়েই করা হয়েছে এই বইটি। সিডনি শ্যানবার্গসহ কিছর সাহসী সাংবাদিকদের কারনে বাইরের দুনিয়া জানতে পারে নিষ্ঠুর সেই গণহত্যার কথা। নিজের চোখে দেখা নানা ঘটনা প্রতিবেদন হিসেবে পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। তার রিপোর্টগুলোর জন্যই বিশ্ববাসি জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম
হত্যাযজ্ঞের কথা। লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল ভারতে, তাদের কথা। সিডনি তার রিপোর্টগুলো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে ছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটি অনুবাদের জন্যে অনুবাদক মফিদুল হককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশিদের লেখা বইগুলো অবশ্যই বাংলায় অনুবাদ হওয়া জরুরী। কারন তাহলেই বুঝতে
পারবো বিদেশিরা কি ভেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ভারতের লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব হচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক বড় একজন বন্ধু। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্যে বিজয় হয়েছিল তরান্বিত। একাত্তরে তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ, তখন তার পদমর্যাদা ছিল মেজর জেনারেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে
মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য আর এক্ষেত্রে জেনারেল জ্যাকবের বিশাল ভূমিকা ছিল। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর পুনর্গঠন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-রসদ জোগান দেয়াসহ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযানে এসে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত জয়ে অসামান্য অবদান রাখে ভারতীয় বাহিনী। সর্বোপরি
তার ভাষ্য থেকে জানা যায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১এ জেনারেল নিয়াজীকে লজ্জাজনক এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তিনি ।
বাংলাদেশের নির্যাতিত ও মুক্তিপ্রাণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এসব বিদেশি বন্ধুরা প্রমাণ করেছিলেন যে, মানবমুক্তির লড়াইয়ে দেশ, রাষ্ট্র, জাতি কোনো বাধা নয়৷ বিশ্বজুড়ে স্বার্থ, হানাহানি ও ঘৃণ্য রাজনীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলেছিলেন মানুষকে ভালোবাসার কথা৷
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন সে সময় নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেন৷ বিশ্বের কাছে তাঁরা তুলে ধরেন পাকিস্থানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার কথা, বাঙালির স্বাধীকারের দাবির কথা৷ মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর আরো একবার প্রমাণিত হলো যে বাঙালি জাতি এক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী৷
দেরিতে হলেও তারা ভোলেনি এই বন্ধুদের অবদান৷ দেশ, রাষ্ট্র, জাতিতে ভিন্নতা যতই থাকুক মনুষত্বই মানুষের পরিচয়৷ মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন বাঙালিরা যুদ্ধ করছে তখন বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ৷
দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের গর্ব। লাখ লাখ মা বোন ভাই দের জীবন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রানের স্বাধীনতা।
বাংলার বীর সেনানিদের গৌরবগাঁথা বাংলার ইতিহাস তো বটেই প্রতিটি মানুষের হৃদয়েও সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাঙালিদের পাশাপাশি
কিছু মানুষ ছিলেন যারা এই দেশের না হয়েও মানবতার টানে এই গৌরবময় জয়ে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। আজ এই বিদেশীদের কির্তিগাথা
নিয়ে কিছু কথা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রয়েছে অসামান্য অবদান ইন্দিরা নামটি শুনলেই মনে হতো তিনি মা দুর্গার মতই যেন কোন মহিয়সী দেবী, যিনি অসুরকে বধ করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন । বাস্তবেও তেমনই ছিলেন তিনি, অদম্য ইচ্ছে এবং প্রবল দাপটের সঙ্গে সকল প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও বন্ধুরতাকে একের পর এক জয় করেছিলেন, দৃঢ়চেতা ও অদম্য সাহসী ইন্দিরা তাঁর চরম মানসিক শক্তি এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ততায় সারা দুনিয়া আলোড়িত করে গিয়েছিলেন, ইতিহাস যে তাকে আয়রন লেডি বলে অভিহিত করেছে তা একেবারেই অযৌক্তিক নয়, লৌহসম দৃঢ় ব্যক্তিত্বে তিনি ভারত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তৈরি করে দিয়ে গেছেন আরেকটি দেশ, আমাদের দেশ বাংলাদেশকে ।ইতিহাস তাঁকে অমরত্ব দেবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অনবদ্য অসাধারণ এবং অনন্য ভূমিকার জন্য । অনন্য সৌন্দর্য ছিলো তাঁর মধ্যে, সেটি তাঁর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য, তাঁর রুচিবোধ, তাঁর তেজস্বিতা , তাঁর ধীরস্থির হয়ে চমৎকারভাবে কথা বলার সৌন্দর্য, তাঁর বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সৌন্দর্য । কপালের ওপর ডায়েস করা একগোছা চুল, তাঁতের শাড়ি এবং দুই ফিতার স্যান্ডেলে তাঁকে খুবই মানাতো । শীতের দেশে গেলে ওভারকোট তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতাকে চরমভাবে ফুটিয়ে তুলতো, তাঁর চালচলন, স্বভাবচরিত্র এবং ব্যক্তিত্বে ছিল চরম নান্দনিকতা । এমন ব্যক্তির প্রতি সহজেই মন শ্রদ্ধাবনত হয়ে আসে, ইচ্ছে করে পুজোর অর্ঘ ঢেলে তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।। তিনি শুধু এক কোটি বাংলাদেশীকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মার্কিন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি।
বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ভারতের বিরুদ্ধেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে সেখানেও এক হয়ে পকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে সেবাযত্ন করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যীশু খৃষ্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা। ‘তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান’ শীর্ষক একটি বইয়ে তেরেসা এ বিষয়টি উল্লেখ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সম্মাননা জানাচ্ছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মনানা ‘স্বাধীনতার সম্মাননা’ জানানো হয় তাকে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্মাননা নেন তার পুত্রবধু সোনিয়া গান্ধী।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রাতের অন্ধকারে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হাজার হাজার নারী, পুরুষ, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা করে। বিভীষিকাময় এ অবস্থায় থেকে বাঁচতে লাখ লাখ নারী-পুরুষ বাধ্য হয়ে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়।
ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন উদ্বাস্ত্তকে আশ্রয় দেন। তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সাহায্য করেন। পরম মমতায় সেদিন ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ান ও আশ্রিতদের সহায়তার জন্য ভারতবাসীকে অনুরোধ করেন।
শুধু উদ্বাস্ত্ত বা শরণার্থীদের আশ্রয়ই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবাদী অথচ নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহস জোগান তিনি। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। এর ফলেই অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হয় বাংলাদেশীদের। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে একের পর এক গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েই, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।” পরে ১৭ মে তিনি পশ্চিমবঙ্গ আসেন। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় নেয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, শরণার্থী বিষয়ে কেন্দ্র তাদের পাশে আছে ও থাকবে।
এর আগেই ৩০ এপ্রিল ’৭১ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। ৯ মে তাদের হাতে দেয়া হয় হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে আগ্রহী বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব।
এছাড়াও, শাসক পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সেসময় বিভিন্ন দেশ সফরও করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়েও সক্ষম হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
সেখানে এক বিশেষ বার্তা পাঠিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “পূর্ববঙ্গের ঘটনায় ভারতের পক্ষে উদাসীন থাকা কঠিন এবং ইতিমধ্যে ২০ লাখ শারণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এসব উদ্বাস্তু যাতে সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারে সেজন্য পাকিস্তানকে বাধ্য করতে হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের বিষয়ে অক্ষমতা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, “ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহয়তা বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই।”
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দেয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতেও আক্রমণ করে। তিনি সেদনিই তার মন্ত্রিসভার ভাষণে বলেন, “আমি এ মুহূর্তে আমাদের দেশের এবং জনগণের গুরুতর বিপদের কথা উল্লেখ করে আপনাদের উদ্দেশে বলছি, কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ করে আমাদের এয়ার ফিল্ড, অমৃতসার, পাঠান কোর্ট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উতরলেট এবং আগ্রায় আঘাত হেনেছে। এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল, তা ভারতের বিরুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’’
এর পরপরই ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী মিলিতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং পাকবাহিনী বিভিন্ন রনাঙ্গণে পরাজিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় অনেক সৈন্যও শহীদ হয়।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও অগণিত মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে।
'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ছিল বাংলাদেশের প্রধান মিত্র। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সরকারের তৎপরতা ও ভারতীয় সৈন্যদের অবদান অপরিসীম।মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা ও অফিসারদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।'২৫ মার্চের পর সারা দেশে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও নির্যাতন শুরু হলে অসংখ্য মানুষ নিরাপত্তার আশায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।তখন ভারত সরকার সীমান্তবর্তী এলাকায় শরনার্থী শিবির স্থাপন করে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।এছাড়া বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী জনমত আদায়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী,পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং,রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজ্জীবন রামের ভূমিকা অনস্বীকার্য।তাই ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ৪৫ হাজার অসহায় বাঙালী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।তাদের মধ্যে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান সব ধর্মের অনুসারীই ছিল।এক কোটি শরণার্থীর লালন-পালনের জন্য ভারত সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা।এর মধ্যে মাত্র ৫০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশ ভারত ও মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য দিয়েছে।শরণার্থীদের লালন-পালন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহসহ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হয়েছে আরো বহু টাকা।সবকিছু মিলে ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে ৭০০ কোটি টাকার বেশি করেছে।ঐ সময়ে ভারতের মত একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা অর্থনৈতিকভাবে সহজ ছিল না।কিন্তু সেটি মূলত সম্ভব হয়েছিল সেসময়কার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূরদর্শীতা ও অসীম প্রজ্ঞার জন্য।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিশ্বের বড় বড় শক্তির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।বাংলাদেশের জনগণ '৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।ভারতের সহযোগিতা না পেলে হয়ত স্বাধীনতা পেতে অনেক বিলম্ব হতে পারত।
আমরা সবাই জানি যে প্রতিটা দেশের সরকার তার প্রতিরক্ষা খাতে কি বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে।তেমনি '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রায় দেড় হাজার অফিসার ও জওয়ান শহীদ হয়েছে।এর মধ্যে ৬৮ জন অফিসার,৬০ জন জুনিয়র কমিশন অফিসার এবং ১২৯৩ জন অন্যান্য স্তরের।আহত হয় ৪০৬১ জন এবং নিখোঁজ হয় ৫৬ জন ।মুক্তিযুদ্ধে একটি সহযোগী দেশ হিসেবে ভারতীয় সৈন্যদের এ আত্মত্যাগ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও এটি সত্য যে,বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে তাদের অবদান সেভাবে উঠে আসেনি।স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশীদেরআমাদের এই আত্মত্যাগ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা উচিত।আসুন,আমরা ৩০ লক্ষ বীর শহীদের পাশাপাশি শহীদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।
এবার যার কথা মনে পড়ছে তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক , উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ড (ওলন্দাজ: Wiliam Ouderland)
(জন্ম:৬ই ডিসেম্বর, ১৯১৭ — মৃত্যু:১৮ই মে, ২০০১) ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করে। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী জাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
ঔডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অস্ট্রেলিয়া ঔডারল্যান্ডের পিতৃভূমি ছিল। তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। ১৭ বছর বয়সে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার
জন্য জুতা-পালিশের কাজ নিতে হয় এবং পরে তিনি বাটা স্যু কোম্পানিতে যোগ দেন। দু'বছর পর চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ডস দখলের আগে ঔডারল্যান্ড ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে নাম লেখান। পরবর্তীতে
তিনি রয়্যাল সিগন্যাল কোরে সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত হন এবং তাঁর দলে ৩৬ জন সদস্য ছিল। তিনি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫)
অংশগ্রহণ করেন। জার্মানী কর্তৃক নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার ফলশ্রুতিতে ঔডারল্যান্ডকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং জার্মানী থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজে নিযু্ক্ত হন।
ঔডারল্যান্ড জার্মান ও ডাচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্টের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন ।
ঔডারল্যান্ড ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। । কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থায়
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে দেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১-এ মার্চের গণ আন্দোলন, ২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী
সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন।
বাটা স্যু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের
পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে
থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয়
কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী,এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাঁকে 'সম্মানিত
অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের
সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এর কাছে।
তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা
প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙ্গালী যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব
রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন,
পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।
এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন।
এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের
মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ঔডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি
এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল
পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তাঁর নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭।
১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ঔডারল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তিনি বীর প্রতীক পদকের সম্মানী ১০,০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টে দান করে দেন।
একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভূষিত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি
ঔডারল্যান্ড বাংলাদেশের বাটা স্যু কোম্পানি থেকে ১৯৭৮ সালে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফেরত যান। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এডওয়ার্ড কেনেডি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার মমতা ও ভালবাসা ইতিহাসে লেখা থাকবে।১৯৭১ এ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার
জন্য লড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টি। আর তাদের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের দিকে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড।
"মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে এনেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশা নিজের
চোখে দেখে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন তিনি। "বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও এ দেশের মানুষের প্রতি মমতা ও ভালবাসা
এভাবেই প্রকাশ করে গেছেন তিনি। এটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।"তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী শিবির দেখতে, তাদের খোঁজ-খবর নিতে।
ঢাকায় কয়েকটি গণকবরে গিয়ে অকুতোভয় বীরদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।
ওই সময় এডওয়ার্ডের মন্তব্য ছিল- পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের (ইসলামাবাদ) প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন '
দুষ্কর্মে' সহযোগিতা করার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় বলেও কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্র"য়ারি ঢাকায় এসেছিলেন এডওয়ার্ড।
এখন যার কথা মনে আসছে তিনি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ - জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (১৯২৮ - জিসেম্বর ৬, ১৯৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানীজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুকাল এদেশে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।করাচী থেকে প্রকাশিত দ্য মর্নিং নিউজ-এর প্রধান সংবাদদাতা এবং পরবর্তীতে সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত ছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সনের মে মাস পর্যন্ত। একাত্তর সনের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে এসে গণহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এরপর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের সানডে টাইম্স পত্রিকায় গণহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করেন। এজন্য তিনি স্বয়ং ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পত্রিকাটির ১৯৭১ সনের জুন ১৩ সংখ্যায় এ সকল তথ্যাদি প্রকাশিত হয়। এতে বিশ্ব বিবেক অনেকাংশেই জাগ্রত হয় এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে পারে। তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী অন্তরঙ্গ আলোকে প্রত্যক্ষ করে সংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে তা বর্ণনা করেছেন। তার লেখা বই হচ্ছে “দা রেইপ অব বাংলাদেশ” এবং “বাংলাদেশের রক্তের ঋণ”।
তার দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ গ্রন্থটি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। বইটির সেই প্রাথমিক সংস্করণে শেষ পংক্তিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সম্বন্ধে বলেছিলেন,
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস
আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।
“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”
প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”
রক্তের প্রথম দাগ..................
উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।
এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।
এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।
এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।
২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।
পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।
দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।
চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”।রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।
কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”
কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।
অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।
আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।
পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।
বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”
কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”
হিন্দু নিধন..................
নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।
হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”
অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”
অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”
সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।
অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।
জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................
এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।
সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)
ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।
এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।
১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।
দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।
এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।
১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।
মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................
এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।
পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।
বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।
এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।
“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।
বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।
এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।
মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।
লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।
যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।
এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।
আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................
বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।
এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।
সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।
বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।
এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।
মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।
গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।
গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।
কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।
“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”
কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।
রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।
মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।
এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।
ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।
এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।
মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।
একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।
হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................
এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।
“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।
যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।
চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।
কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
জুন ১৩, ১৯৭১
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস
আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।
“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”
প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”
রক্তের প্রথম দাগ..................
উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।
এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।
এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।
এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।
২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।
পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।
দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।
চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”। রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।
কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”
কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।
অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।
আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।
পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।
বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”
কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”
হিন্দু নিধন..................
নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।
হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”
অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”
অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”
সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।
অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।
জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................
এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।
সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)
ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।
এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।
১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।
দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।
এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।
১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।
মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................
এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।
পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।
বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।
এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।
“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।
বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...
বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।
এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।
মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।
লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।
যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।
এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।
আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................
বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।
এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।
সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।
বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।
এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।
মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।
গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।
গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।
কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।
“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”
কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।
রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।
মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।
এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।
ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।
এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।
মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।
একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।
হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................
এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।
“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।
যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।
চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।
কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
সাইমন ড্রিং (জন্মঃ ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫) একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতা। তিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক জায়গা ভ্রমণ করে তরতাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলী টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন এবং রেডিও সংবাদ ও চলতি ঘটনা তুলে ধরার লক্ষ্যে অনবরত কাজ করছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে
তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ দৈনিকে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরী করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে - হোটেল শেরাটন, বর্তমানে - হোটেল রূপসী বাংলা) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,[২]
“ আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...। ”
১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুণরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার; ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ; কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য সনি এবং হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ। তিনি একজন সেরা প্রুফ রিডারও ছিলেন
এরপর আসছেন সিডনি শ্যানবার্গের নাম । সিডনি শ্যানবার্গ ছিলেন দি নিউইয়র্ক টাইমস এর একজন সাংবাদিক। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটস এ জন্মগ্রহন করেন ।১৯৫৯ সালে তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমস এ যোগদেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চএর হত্যাকান্ড তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। সে সময় তিনি ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলের জানালা দিয়ে
তিনি দেখেন ইতিহাসের এক ভয়ানক হত্যাকান্ড । তিনি পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খন্ড খন্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী দের অবস্থা ।তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্ববাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ ।সংকলনটির নাম ডেটলাইন
বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক ।
ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল। আমি মনে করি ১৯৭১ সালের পরের প্রজন্মের এই ধরনের বইগুলো বেশি বেশি করে পড়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ভিনদেশিকে আমরা বন্ধু হিসাবে কাছে পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে কেউ সাহায্য করেছিল প্রত্যক্ষ ভাবে কেউ পরোক্ষ ভাবে। তাদেরই একজন হলেন সিডনি শ্যানবার্গ। দি নিউইয়র্ক টাইমস এর এই
সাংবাদিকের কাছে বাংলাদেশের মানুষের অনেক ঋন আছে। আমরা অবশ্যই তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ২৫শে মার্চের পাকিস্থানিদের চালানো গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী সিডনি শ্যানবার্গ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বিদেশিদের অনেকগুলো বই আছে। সবগুলো পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে যেকটি পড়েছি তারমধ্যে ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটিকে বেষ্ট মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়
শ্যানবার্গ বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন তার পেশাগত দায়িত্বের কারনে। সেই সময় করা তার রিপোর্টগুলো নিয়েই করা হয়েছে এই বইটি। সিডনি শ্যানবার্গসহ কিছর সাহসী সাংবাদিকদের কারনে বাইরের দুনিয়া জানতে পারে নিষ্ঠুর সেই গণহত্যার কথা। নিজের চোখে দেখা নানা ঘটনা প্রতিবেদন হিসেবে পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। তার রিপোর্টগুলোর জন্যই বিশ্ববাসি জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম
হত্যাযজ্ঞের কথা। লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল ভারতে, তাদের কথা। সিডনি তার রিপোর্টগুলো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে ছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান বইটি অনুবাদের জন্যে অনুবাদক মফিদুল হককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশিদের লেখা বইগুলো অবশ্যই বাংলায় অনুবাদ হওয়া জরুরী। কারন তাহলেই বুঝতে
পারবো বিদেশিরা কি ভেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ভারতের লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব হচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক বড় একজন বন্ধু। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্যে বিজয় হয়েছিল তরান্বিত। একাত্তরে তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ, তখন তার পদমর্যাদা ছিল মেজর জেনারেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে
মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য আর এক্ষেত্রে জেনারেল জ্যাকবের বিশাল ভূমিকা ছিল। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর পুনর্গঠন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-রসদ জোগান দেয়াসহ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথ অভিযানে এসে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত জয়ে অসামান্য অবদান রাখে ভারতীয় বাহিনী। সর্বোপরি
তার ভাষ্য থেকে জানা যায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১এ জেনারেল নিয়াজীকে লজ্জাজনক এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তিনি ।
বাংলাদেশের নির্যাতিত ও মুক্তিপ্রাণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এসব বিদেশি বন্ধুরা প্রমাণ করেছিলেন যে, মানবমুক্তির লড়াইয়ে দেশ, রাষ্ট্র, জাতি কোনো বাধা নয়৷ বিশ্বজুড়ে স্বার্থ, হানাহানি ও ঘৃণ্য রাজনীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলেছিলেন মানুষকে ভালোবাসার কথা৷
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন সে সময় নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেন৷ বিশ্বের কাছে তাঁরা তুলে ধরেন পাকিস্থানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার কথা, বাঙালির স্বাধীকারের দাবির কথা৷ মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর আরো একবার প্রমাণিত হলো যে বাঙালি জাতি এক বিশাল হৃদয়ের অধিকারী৷
দেরিতে হলেও তারা ভোলেনি এই বন্ধুদের অবদান৷ দেশ, রাষ্ট্র, জাতিতে ভিন্নতা যতই থাকুক মনুষত্বই মানুষের পরিচয়৷ মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন বাঙালিরা যুদ্ধ করছে তখন বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ৷
Comments
Post a Comment