ছদ্মবেশী ৩
ছদ্মবেশী ৩
দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
আমি যে জায়গাটাতে থাকি তার তিন দিকে নদী বয়ে চলেছে । নদী এখানে সমুদ্রের মতন বিশাল বিস্তৃত কায়া ধারণ করেছে । এখানে দুটি নদীর সঙ্গম স্থল,কিছুটা দূরে গিয়ে তারা সাগরে মিলিত হয়েছে । নদীর ধারটিও বেশ মনোরম । ভাঙ্গা জাহাজ কারখান,বনবাদাড়, নদীপথে বন্দরে আগত জাহাজ আর ঝড় হাওয়ার সাথে দুটি নদীর উদ্দামতা সব মিলিয়ে রোমাঞ্চক নৈসর্গিক বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছেন প্রকৃতি দেবী । সন্ধের সময় থেকে বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়,তাই গ্রামের মানুষজন বিকেলের পর আর ও মুখো হয় না ।
আমি যে জায়গাটার কথা বলছি তার ভয়ঙ্কর সুন্দর আদিম রূপের মাঝে যেকোনো মানুষের গা ঢাকা দেবার এক নিরাপদ পরিবেশ ও তৈরি করেছেন প্রকৃতি দেবী । সমুদ্র থেকে নদী পথে যে কেউ এখানে এসে মিশে যেতে পারে সাধারণ মানুষের সাথে । পাঠকরা হয়ত ভাবছেন আমি এইসব আজিরা কথা কেন বলছি,এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে । এবার গৌরচন্দ্রিকা শেষ করে আসল কথায় আসি । গত কয়েক মাস ধরে আমাদের পরিচিত কিছু স্থানীয় মানুষ বলছেন তারা এখানে কিছু অপরিচিত মুখ ঘোরাফেরা করতে দেখছেন যারা শুদ্ধ উর্দু ভাষায় কথা বলেন।আমরা কথাটায় অতোটা গুরুত্ব দিই নি । কিন্তু আজ সকালে আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজে আমাকে আমাদের বাড়ীর সামনে একটি MEDICAL SHOP এ যেতে হয়,ফেরার পথে আমি তিনটি অল্প বয়সী ছেলেকে দেখি যারা নিজেদের মধ্যে শুদ্ধ উর্দু ভাষায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে । এখন দুটো প্রশ্ন মায়া কাজ করছে, ভারত আর বাংলাদেশের বাঙ্গালি মুসলিমরা কি উর্দু ভাষা কথা বলেন ? আমার উত্তর না বলে না,তারা আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় কথা বলেন । ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিমরাও নিজেদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলেন না । তা হলে ? হ্যাঁ তা হলে এরা কারা ? কিভাবে এলো এখানে ? অল্পবয়সী ছেলে কেন রাস্তায় উর্দুতে কথা বলবে ? মানুষ ব্যক্তিগত কথাবার্তা মাতৃভাষায় বলে জানি । তবে কি উর্দু তাদের মাতৃভাষা ? এবার মাথায় প্রশ্ন আসে কোন দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দু ? এই প্রশ্নটা আসতেই শরীর হিম হয়ে যায় ।
এই লেখাটা লিখতে বসে একটি ছেলের কথা খুব মনে পড়ছে, ধরলাম ছেলেটির নাম X, এই অঞ্চলে ৬ বছর গাড়ি চালায় । আগে জানতাম ও বিহার থেকে এসেছে । এখানে এসে এখানকার একটি মেয়েকে ও বিয়ে করেছে । হাসিখুশি, ফর্সা সুন্দর চেহারার ছেলেটি এখানকার মানুষের কাছে খুব প্রিয় ,কাছের একজন মানুষ । একবার ওর গাড়ি ভাড়া নিয়ে আমরা নর্থ বেঙ্গল বেরাতে গেছিলাম । দীর্ঘ পথ খুব তাড়াতাড়ি আমরা পার করেছিলাম X এর সাথে গল্প করে । ওর কাছ থেকে জানলাম ও হরিয়ানার মুসলিম পরিবারের ছেলে, হরিয়ানায় কোন কাজ নেই তাই ও পশ্চিম বঙ্গের এই পাড়া গাঁয়ে গাড়ি চালাতে এসেছে ।
এখানে এসে এখানকার মেয়ে কে বিয়ে করে সংসার করছে । কিন্তু বেশি দিন থাকবে না,আরবে ওর দুই দাদা থাকে, ও তাদের কাছে চলে যাবে,কারণ ওখানে ড্রাইভারদের অনেক পয়সা । আমার ওর কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয় নি, আমি ওকে সে কথা পরিষ্কার জানিয়েও দিন এবং তার সাথে ওকে প্রশ্নও করি "ভাই,তুমি পাকিস্তানী না তো ?" .........ও সারা রাস্তা আমার সাথে মজা করতে করতে যায়, "হ্যাঁ,আমি পাকিস্তানী" । আমার কিন্তু ওর মজাটাকে একেবারেই মজা মনে হয় নি ।
কত রকম চরিত্র দেখি, মাঝে মাঝে তাদের রং চটা মুখ গুলো ধরা পরে যায়, কিন্তু কাকে বলব ? নিজের মানুষটাকে বললে সে বলে এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না,এখনও অনেক কাজ করার আছে । তুমি একা প্রতিবাদ করে কিচ্ছু করতে পারবে না, তোমার মেয়েটার কথা ভাব । সত্যিই তাই, আমি একা বিপ্লব দেখিয়ে কি বা করতে পারব । কিন্তু দেশকে যে বড় বেশি ভালোবাসি,তার নিরাপত্তার প্রশ্নটা যখন মাথায় আসে তখনই রক্ত গরম হয়ে যায় । ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে । তখনই হাতে কলমটা তুলে নিই ।
জয় হিন্দ.......
Comments
Post a Comment