সিরিয়ার ক্যাম্পের সেই মেয়ে টি
সিরিয়ার ক্যাম্পের সেই মেয়ে টি
দেবশ্রী চক্রবর্তী:
সে দিনের কথা ভোলার না, শত চেষ্টা করলেও আমি ভুলতে পারি না । বাগদাদ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে শামারা নামে ছোট্ট এক গ্রাম, যার চার পাশে সারিবদ্ধ হলুদ পাহাড়, বয়ে চলছে নীল নদী আফ্রিন । নদীর পারে সারিবদ্ধ কাঠ বাদামের গাছ,সেই নদীর ধারেই ছিলো আমাদের গ্রাম শামারা । আমার আব্বু কাজ করত খেলনার কারখানাতে, আম্মি আমাদের ৫ ভাই বোনকে আর সংসার সামলাতেই সারা দিন ব্যস্ত থাকতো । কি সুখেরই না সে দিন ছিলো , আমরা তিন বোন আর দুই ভাই সকালে স্কুলে যেতাম । স্কুলটা ছিলো পাহাড়ের গা ঘেঁষে এক ডালিমের বাগিচার ভিতরে । আব্বু আমাদের বাজার থেকে আশমানি রঙ্গের দোপাট্টা এনে দিয়েছিল, তাই দিয়ে মাথা ঢেকে আমরা তিন বোন সুলতান দরজির সেলাই করা হলুদ কুর্তা পাজামা পড়ে স্কুলে যেতাম, ভাইরা পড়ত সাদা পাঠানি কুর্তা পাজামা । কি সুখের না দিন ছিলো, আকাশে আশমানি রঙের মাঝে সাদা কবুতর উড়ত । একবার ছোট ভাইটার কবুতর খাবার খুব ইচ্ছা হয় , আব্বু ওকে বাজারে নিয়ে গিয়ে একটা কবুতর পছন্দ করতে বলে । ও একটা সাদা স্বাস্থ্যবান কবুতর পছন্দ করে বসে । আব্বু ওকে কবুতর টা কিনে দিয়ে কবুতর টা হাতে নিয়ে উরিয়ে দেয়ে । ভাই বলে এ আপনি কি করলেন আব্বু ? আব্বু বলেন ওর যেখানে স্থান ওকে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম বেটা, দেখতো কত সুন্দর লাগছে ওকে । এই ছিলেন আমাদের আব্বু , মেয়েদের আব্রুর মধ্যে থেকে স্কুলে পাঠাতেন আবার ছেলেমানুষের মতন আশমানে কবুতর ওড়াতেন । আব্বু খুব ওস্তাদ মানুষ ছিলেন । ফারশি,আরবি সব ভাষা জানতেন । কুরান শরিফ ছিলো তার কণ্ঠস্থ । কাঁচা সোনার মতন রং ,দেবদূতের মতন চেহারা , গাঁয়ের মানুষ তাঁকে খুব মান্যি করত । এই দেখ, কথা বলতে বলতে নিজের পরিচয়টাই তো দিতে ভুলে গেছি গো । আমি নাসিফা, আমি ইরাকের এক হতভাগ্য নারী, আজ তোমাদের কিছু কথা বলবো বলে কলম ধরেছি । এত সুখের মাঝেও নিজেকে হতভাগ্য বলছি, কেন বলছি তার কারণ আছে গো, সব টাই বলবো বলে আজ কলম ধরেছি । কি যেন বলছিলাম, হ্যাঁ আমি বলছিলাম আমার গ্রামের কথা । ঈদের সময় পাহাড়ের খাঁজে যখন চাঁদ উঠত, তার রং এসে পড়ত পাহাড়ের গায়ে, মনে হত সোনার পাহাড়ের মাঝে সোনার চাঁদ। সারা গ্রাম মেতে উঠত ঈদের আনন্দে । বিরিয়ানি,গোস্ত,সিমুই,ফিরনির গন্ধে চারদিক ম ম করত । নাচগান আনন্দে আমরা মেতে উঠতাম । এরকমই এক রাতে ওয়াসিম চাঁচা আব্বুকে ডেকে নিয়ে গেল । গ্রামে কিছু নতুন মানুষ এসেছেন যারা জিহাদের কথা বলছেন । আব্বু বেরিয়ে গেলে আমি আম্মিকে জিজ্ঞাসা করি আম্মি জিহাদ কি । আম্মির মুখে অমাবস্যা ছায়া দেখতে পাই । আম্মি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মুখে বাইরে চেয়ে আছে, তার দৃষ্টি ভয়ঙ্কর । কি হলো কিছুই বুঝলাম না । সেদিন রাতে আব্বু আনেক দেড়ি করে ফিরল। রাতে আম্মি আর আব্বু কথা বলছে শুনলাম, কিন্তু কথা খুব অস্পষ্ট , একটা কথাই কানে আসছিল পরিস্থিতি ভালো না, ছেলে মেয়েদের সরিয়ে দিতে হবে । আম্মি বার বার বলছিল কোথায় পাঠাবে ? তিন কুলে তো কেউ নেই । তার চেয়ে এখানে সবাই এক সাথে আছি এটাই ভালো । এখন থেকে রোজ রাতে মিটিং হয় , আব্বু যেতে না চাইলেও মিটিং এ জোর করে যেতে হয় । ওয়াসিম চাঁচা আব্বুকে ডেকে নিয়ে যায়, বলে ওদের কাছে মেশিন গান আছে,না গেলে ঝাঁঝরা করে দেবে ।
সেদিন আশমানে সোনার থালার মতন সূর্য উঠেছিল, আমরা তিন বোন জুমর শেখের কাছ থেকে কাঁচের চুরি কিনছিলাম,সূর্যের আভায় ঝলমল করছিল চুড়ি গুলা, ভাই দুটা অন্য ছেলেদের সাথে ঘুড়ি উরাচ্ছিল । নীল আশমানে হলুদ,লাল,সবুজ ঘুড়ি গুলো কি সুন্দর লাগছিল । এমন সময় গ্রামে ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে জমি কাঁপিয়ে কিছু ট্রাক এসে ঢুকল, প্রথমটা অতটা বুঝতে পারিনি, ভেবেছিলাম বোধয় ভূমিকম্প হচ্ছে । পরে দেখি এই ব্যাপার । ট্রাক থেকে কিছু বন্দুক হাথে লোক এসে নামতে থাকে গ্রামে । আমরা প্রথমটা কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছিল, আসলে গ্রামের সহজ সরল মানুষ আমরা, এ সব কি বুঝি ? না কোন দিন এ সব চোখে দেখেছি ? লোক গুলো এসে আমাদের বলল আজ থেকে স্কুল বন্ধ,কোন পড়াশুনা হবে না । শুধু শরিয়তের নিয়ম এখানে চলবে । ঠিক সময় মতন মসজিতে যেতে হবে, নামাজ পড়তে হবে , না হলে গলা কাঁটা যাবে । ইয়াকুব চাঁচার বড় ছেলে ওমর ভাই গর্জে উঠল, ও বলল, নবীজি কোথায় বলে গেছেন নামাজ না পড়লে গলা কাঁটা পড়বে ? কোথায় তিনি বলেছেন পড়াশুনা করা যাবে না, আমাকে দেখাও । যেই না বলা একটা লোক এসে আমাদের সবার সামনে ওমর ভাই এর গলায় কোপ বসালো, তখনো ওমর ভাই জীবিত, ওঁরা ওর বুক চিঁড়ে হৃদপিণ্ড টা বের করে নিলো । আমাদের চোখের সামনে ওমর ভাইয়ের হৃদপিণ্ড দিয়ে রক্ত চুয়ে লাল হয়ে গেলো বাগদাদ থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে শামারার মাটি । এত বড় ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু কোন কাগজে তা ছাপা হল না, কোন টিভিতে তা দেখান হলোনা । রাজধানী থেকে সৈন্য আসা তো দূরে থাক একটা পুলিশ এলো না । আব্বু আজকাল বড় বেশি চুপচাপ হয়ে গেছেন , সেই উৎফুল্লতা আর কারুর মধ্যে নেই , আহা ইয়াকুব চাঁচার মুখের দিকে চাওয়া যায় না । এত বড় জোয়ান বেটার শোক কি চাড্ডিখানিক কথা নাকি । আবার এক চাঁদনি রাত এলো, আমাদের গ্রামের সাদা পাথরের মসজিদের মাথায় শ্বেত পাথরের থালার মতন চাঁদ উঠল । আজ ঘরে আমি একা,আম্মি আর ভাই বোন দের নিয়ে আব্বু আমাকে রেখে কোথায় গেছে,কিছু বলে যায় যায় । আমই একা, কিন্তু সত্যি বলছি এখনো মনে পড়ে আমার ভয় লাগছিল না , একটুও না ।
হটাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হল , আমই এগিয়ে গেলাম বাইরের ঘরে,আব্বুরা এসেগেছে ভেবে । কিন্তু না,এতো আমার আব্বু না , এতো অন্য একটা লোক । লোকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমই বললাম আপনি পাপ করছেন,আমাকে ছেড়ে দিন । লোকটা বলল না কোন পাপ করছি না,এতে আমার জন্নত হাসিল হবে । লোকটা আল্লাকে স্মরণ করে বির বির করে কি বলে আমার ওপর অত্যাচার করা শুরু করে দিলো । আমই বললাম আল্লা তোমকে নরকে ঠাই দেবে । ও কোন কথা শুনল না । আমার আম্মি আব্বু এলে লোকটা চলে গেল । আমি আম্মিকে বললাম,কেন করলে আমার এই সর্বনাশ ? আম্মি পাথরের মতন বলেছিল না করছে ওঁরা আমাদের কারুকে বাঁচতে দিত না । এই ভাবে দিনের পড় দিন ওঁরা আমার ওপর অত্যাচার চালাতে থাকল । পরে এর নাম জেনেছিলাম সেক্স জিহাদ । অত্যাচার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেছিল তখন এক রাতে আব্বু আমাদের নিয়ে আফরিনে নাও ভাসিয়ে অনিশ্চিত কোন এক উদ্দেশ্যে ভেসে পরল । সে কি ভয়ঙ্কর কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না । শুধু পানি আর পানি । পানি দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেলো । খিদে তৃষ্ণা সব মুছে গেছিল শরীর থেকে । আশ্চর্য লাগছিল যখন দেখলাম আব্বু আম্মি কিরকম পাথরের মতন হয়ে গেছিল,কোন কথা নেই তাঁদের মুখে । আমরা ছেলে পুলে অতটা তখন বুঝলাম না এখন বুঝি এই সর্বনাশের পর কারুর মুখ থেকে আর কথা বের হয় না ।
প্রায় ৭ থেকে ৮ দিন জলে থাকার পডর আমরা একটা বড় শহরে এসে পউছালাম ,পরে হারে হারে বুঝেছি সেই শহরের নাম দামাস্কাস । আব্বু আমার ওস্তাদ মানুষ,দু তিন রকুমের ভাষা জানে ,আব্বু খবরের কাগজে পরেছিল সিরিয়া তে ইরাকের ক্যাম্প হয়েছে । একে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে আমরা উতবাস্তু ক্যাম্পে পউছালাম । গিয়ে দেখি আমাদের আগে বেশ কিছু ইরাকী পরিবার দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন এখানে । তাঁদের সাথে আমরা থাকতে লাগলাম । আস্তে আস্তে আরও পরিবার আসতে থাকল । আমাদের গ্রামের থেকে বহু পরিবার এখানে চলে এলো । ওঁদের থেকে জেনেছিলাম আমাদের গ্রামের মেয়ে দের যৌন দাসী বানিয়ে নিয়ে গেছে ওঁরা, কিছু ছেলে প্রাণের ভয়ে ওঁদের সাথে যোগ দিয়েছে । প্রথম প্রথম দিন গুলো ভালী কাটছিল, একটাই রসুইখানা ছিলো, সেখানে সবার রান্না এক সাথে হত । ছেলে রা এক সাথে খেলত,মেয়েরা এক সাথে গল্প করত । আমরা বহুদিন পর গ্রামের সেই দিন গুলো ফিরে পেলাম । আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম । ভালোই কাটছিল । সারা দিন ভালো কাটলেও রাতে ক্যাম্পে কোন সুরখ্যা ছিল না । খবর আসতে থাকল মেয়ে তুলে নিয়ে যাবার । আমাদেরও ভীমরতি হয়েছিল, আমরা ব্যাপারটা গুরুত্ব দিলাম না । আমার ১০ বছরের ছোট বোনটার এক রাতে বেগ এলো । সে আর চাপার ক্ষমতা তার থাকল না, কি আর করবে বলো, বাচ্চা মেয়ে কি আর পারে । আম্মি ওকে নিয়ে গেল বাইরে । সারা রাত কেটে গেল ওঁরা আর ফিরল না । হামিদ ভাই নাকি দেখেছেন কিছু লোক আম্মি আর বুনটাকে মুখ চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে । ক্ষতবিক্ষত আম্মি এক সপ্তাহ পর ফিরে এলো , কিন্তু বোনটার কোন খোঁজ আমরা পেলাম না । আম্মি বলেছিল বোনের মতন ছোট মেয়েদের রাতে বাগান বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বুড়া শেখ দের রসনা তৃপ্তির জন্য । আব্বু রোজ রাতে খোঁজ নিত কোথায় বোনকে পাওয়া যায় । এই ভাবে খোঁজ নিতে নিতে আব্বু ওঁ এক দিন নিখোঁজ হয়ে গেলো । সে আর ফিরল না । আমরা যখন এখানে এসেছিলাম আমাদের সাথে আরেকজন এসেছিল, আমরা প্রথম প্রথম তার আস্তিত্ব বুঝতে পাড়ি নি । পরে বুঝলাম যখন তখন আনেক দেড়ি হয়ে গেছে , আম্মি তাঁকে সরাবার চেষ্টা করেনি । কারণ ইসলামে ভ্রূণ হত্যা পাপ । গ্রাম থেকে ফেরার ১০ মাস পড় আমি একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিলাম, আম্মি নাম রাখল নূর । তার রূপের ছটায় আমদের ক্যাম্পে চাঁদের আলো ফুটল । ছোট বোনটা আর ফিরল না, মেজ বোনটা ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছে দেখে আমাদের সত্যি চিন্তার শেষ ছিলো না । অবশেষে এক আরবি শেখের সাথে তাঁকে নিকা করান হল । শেখের বয়েস অনেক বেশি হলেও তার আবস্থা বেশ ভালো ছিলো, আমার বোন সুখে আছে । শেখরা সিরিয়ার ক্যাম্পে বউ খুঁজতে আসেন কারণ এখানে অন্য দেশের চেয়ে সস্থায় বউ পাওয়া যায় । এরা বাচ্চা সুদ্ধু মহিলাকেও নিকা করেন ।
আব্বু,দুই বোন সবাই,একে একে বিদায়ী নিলো, পরে থাকলাম আম্মি,আমি দুই ভাই আর আমার নূর । আম্মির শরীরটা আজকাল ভালো যায় না, সান্ধ্যা হলে জ্বর আসে, কাশলে রক্ত বের হয় । আম্মি নূরকে আজকাল ধরে না, বলে ওকে দূরে রাখ । মেজ বোনটাকে দিয়ে শেখের কাছ থেকে যেটুকু টাকা পেয়েছিলাম তা প্রায় শেষের পথে । আম্মির চিকিৎসার পেছনে সব থেকে বেশি খরচা হয়ে গেছে । এক দিন সন্ধ্যার নামাজের সময় আম্মি দেখলাম ঢলে পরে গেলো,সেই যে গেলো আর চোখ খুলল না । আমরা অনাথ হলাম । এখানে সব কটা পরিবারের সবার কিছু না কিছু গল্প আছে । সে কথা বলতে গেলে আমার বলা শেষ হবে না,কিন্তু আপনাদের চোখের পানি শেষ হয়ে যাবে । নূর বড় হচ্ছে, আজ ৬ মাস পারে গেছে,এখন বুকের দুধেও ওর পেট ভরে না , আর বুকে দুধ থাকলে তো খাবে তাই না ! পেট ভরে না খেলে আর বুকে দুধ হবে কি করে ! নূরের কান্না দিন দিন বাড়তে থাকল , ভাই গুলোও বড্ড ছোট, এখনো রোজগারের বয়েস তাঁদের হয়নি । আমাকেই এক দিন কাজের সন্ধানে বের হতে হল রাস্তায় । কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না । লেখাপড়া জানলে হয়তো পেতাম , কিন্তু স্কুলটাই শেষ করা হ্যনি,কাজ পাই কি করে । কিছু মানুষ শারীরের প্রস্তাব দিলো । তাঁরা বলল, আমি সুন্দরী ,আমি শরীর দিলে ওঁরা আমাকে অনেক টাকা দেবে । আমি প্রথমে রাজি হই নি । সত্যি বলছি হয়নি। কিন্তু নূরের কান্না আর ভাইদের অভুক্ত মুখ গুলোর কাছে নিজে সতী সেজে থাকাটা সত্যি স্বার্থপরের মতন লাগছিল । আমি সত্যি বলছি আমি বাধ্য হয়ে ওই লাইলে নামলাম । আমাদের দেশের অবস্তা সত্যি ভালো না । খাদ্য নেই,বাসস্থান নেই,নেই কোন সুরক্ষা । এখানে রোজ কোন না কোন মেয়ে কে বলি হতে হচ্ছে । কি আর করা যাবে এক দল বন্দুক ধারি দের কাছে যে আমরা বড়ো অসহায় । সারা পৃথিবীর মানুষ ও সব দেখে নির্বাক । আমরা কি করতে পারি । আমার আব্বু ছিলেন একজন নেক মুসলমান, কিন্তু আজ আমাদের এই পরিণতি । হে আল্লা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আমাদের অবস্থা, না তুমিও তো আজকাল বন্দুকধারীদের হাথে বন্দি ।
হটাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হল , আমই এগিয়ে গেলাম বাইরের ঘরে,আব্বুরা এসেগেছে ভেবে । কিন্তু না,এতো আমার আব্বু না , এতো অন্য একটা লোক । লোকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমই বললাম আপনি পাপ করছেন,আমাকে ছেড়ে দিন । লোকটা বলল না কোন পাপ করছি না,এতে আমার জন্নত হাসিল হবে । লোকটা আল্লাকে স্মরণ করে বির বির করে কি বলে আমার ওপর অত্যাচার করা শুরু করে দিলো । আমই বললাম আল্লা তোমকে নরকে ঠাই দেবে । ও কোন কথা শুনল না । আমার আম্মি আব্বু এলে লোকটা চলে গেল । আমি আম্মিকে বললাম,কেন করলে আমার এই সর্বনাশ ? আম্মি পাথরের মতন বলেছিল না করছে ওঁরা আমাদের কারুকে বাঁচতে দিত না । এই ভাবে দিনের পড় দিন ওঁরা আমার ওপর অত্যাচার চালাতে থাকল । পরে এর নাম জেনেছিলাম সেক্স জিহাদ । অত্যাচার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেছিল তখন এক রাতে আব্বু আমাদের নিয়ে আফরিনে নাও ভাসিয়ে অনিশ্চিত কোন এক উদ্দেশ্যে ভেসে পরল । সে কি ভয়ঙ্কর কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না । শুধু পানি আর পানি । পানি দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেলো । খিদে তৃষ্ণা সব মুছে গেছিল শরীর থেকে । আশ্চর্য লাগছিল যখন দেখলাম আব্বু আম্মি কিরকম পাথরের মতন হয়ে গেছিল,কোন কথা নেই তাঁদের মুখে । আমরা ছেলে পুলে অতটা তখন বুঝলাম না এখন বুঝি এই সর্বনাশের পর কারুর মুখ থেকে আর কথা বের হয় না ।
প্রায় ৭ থেকে ৮ দিন জলে থাকার পডর আমরা একটা বড় শহরে এসে পউছালাম ,পরে হারে হারে বুঝেছি সেই শহরের নাম দামাস্কাস । আব্বু আমার ওস্তাদ মানুষ,দু তিন রকুমের ভাষা জানে ,আব্বু খবরের কাগজে পরেছিল সিরিয়া তে ইরাকের ক্যাম্প হয়েছে । একে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে আমরা উতবাস্তু ক্যাম্পে পউছালাম । গিয়ে দেখি আমাদের আগে বেশ কিছু ইরাকী পরিবার দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন এখানে । তাঁদের সাথে আমরা থাকতে লাগলাম । আস্তে আস্তে আরও পরিবার আসতে থাকল । আমাদের গ্রামের থেকে বহু পরিবার এখানে চলে এলো । ওঁদের থেকে জেনেছিলাম আমাদের গ্রামের মেয়ে দের যৌন দাসী বানিয়ে নিয়ে গেছে ওঁরা, কিছু ছেলে প্রাণের ভয়ে ওঁদের সাথে যোগ দিয়েছে । প্রথম প্রথম দিন গুলো ভালী কাটছিল, একটাই রসুইখানা ছিলো, সেখানে সবার রান্না এক সাথে হত । ছেলে রা এক সাথে খেলত,মেয়েরা এক সাথে গল্প করত । আমরা বহুদিন পর গ্রামের সেই দিন গুলো ফিরে পেলাম । আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম । ভালোই কাটছিল । সারা দিন ভালো কাটলেও রাতে ক্যাম্পে কোন সুরখ্যা ছিল না । খবর আসতে থাকল মেয়ে তুলে নিয়ে যাবার । আমাদেরও ভীমরতি হয়েছিল, আমরা ব্যাপারটা গুরুত্ব দিলাম না । আমার ১০ বছরের ছোট বোনটার এক রাতে বেগ এলো । সে আর চাপার ক্ষমতা তার থাকল না, কি আর করবে বলো, বাচ্চা মেয়ে কি আর পারে । আম্মি ওকে নিয়ে গেল বাইরে । সারা রাত কেটে গেল ওঁরা আর ফিরল না । হামিদ ভাই নাকি দেখেছেন কিছু লোক আম্মি আর বুনটাকে মুখ চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে । ক্ষতবিক্ষত আম্মি এক সপ্তাহ পর ফিরে এলো , কিন্তু বোনটার কোন খোঁজ আমরা পেলাম না । আম্মি বলেছিল বোনের মতন ছোট মেয়েদের রাতে বাগান বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বুড়া শেখ দের রসনা তৃপ্তির জন্য । আব্বু রোজ রাতে খোঁজ নিত কোথায় বোনকে পাওয়া যায় । এই ভাবে খোঁজ নিতে নিতে আব্বু ওঁ এক দিন নিখোঁজ হয়ে গেলো । সে আর ফিরল না । আমরা যখন এখানে এসেছিলাম আমাদের সাথে আরেকজন এসেছিল, আমরা প্রথম প্রথম তার আস্তিত্ব বুঝতে পাড়ি নি । পরে বুঝলাম যখন তখন আনেক দেড়ি হয়ে গেছে , আম্মি তাঁকে সরাবার চেষ্টা করেনি । কারণ ইসলামে ভ্রূণ হত্যা পাপ । গ্রাম থেকে ফেরার ১০ মাস পড় আমি একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিলাম, আম্মি নাম রাখল নূর । তার রূপের ছটায় আমদের ক্যাম্পে চাঁদের আলো ফুটল । ছোট বোনটা আর ফিরল না, মেজ বোনটা ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছে দেখে আমাদের সত্যি চিন্তার শেষ ছিলো না । অবশেষে এক আরবি শেখের সাথে তাঁকে নিকা করান হল । শেখের বয়েস অনেক বেশি হলেও তার আবস্থা বেশ ভালো ছিলো, আমার বোন সুখে আছে । শেখরা সিরিয়ার ক্যাম্পে বউ খুঁজতে আসেন কারণ এখানে অন্য দেশের চেয়ে সস্থায় বউ পাওয়া যায় । এরা বাচ্চা সুদ্ধু মহিলাকেও নিকা করেন ।
আব্বু,দুই বোন সবাই,একে একে বিদায়ী নিলো, পরে থাকলাম আম্মি,আমি দুই ভাই আর আমার নূর । আম্মির শরীরটা আজকাল ভালো যায় না, সান্ধ্যা হলে জ্বর আসে, কাশলে রক্ত বের হয় । আম্মি নূরকে আজকাল ধরে না, বলে ওকে দূরে রাখ । মেজ বোনটাকে দিয়ে শেখের কাছ থেকে যেটুকু টাকা পেয়েছিলাম তা প্রায় শেষের পথে । আম্মির চিকিৎসার পেছনে সব থেকে বেশি খরচা হয়ে গেছে । এক দিন সন্ধ্যার নামাজের সময় আম্মি দেখলাম ঢলে পরে গেলো,সেই যে গেলো আর চোখ খুলল না । আমরা অনাথ হলাম । এখানে সব কটা পরিবারের সবার কিছু না কিছু গল্প আছে । সে কথা বলতে গেলে আমার বলা শেষ হবে না,কিন্তু আপনাদের চোখের পানি শেষ হয়ে যাবে । নূর বড় হচ্ছে, আজ ৬ মাস পারে গেছে,এখন বুকের দুধেও ওর পেট ভরে না , আর বুকে দুধ থাকলে তো খাবে তাই না ! পেট ভরে না খেলে আর বুকে দুধ হবে কি করে ! নূরের কান্না দিন দিন বাড়তে থাকল , ভাই গুলোও বড্ড ছোট, এখনো রোজগারের বয়েস তাঁদের হয়নি । আমাকেই এক দিন কাজের সন্ধানে বের হতে হল রাস্তায় । কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না । লেখাপড়া জানলে হয়তো পেতাম , কিন্তু স্কুলটাই শেষ করা হ্যনি,কাজ পাই কি করে । কিছু মানুষ শারীরের প্রস্তাব দিলো । তাঁরা বলল, আমি সুন্দরী ,আমি শরীর দিলে ওঁরা আমাকে অনেক টাকা দেবে । আমি প্রথমে রাজি হই নি । সত্যি বলছি হয়নি। কিন্তু নূরের কান্না আর ভাইদের অভুক্ত মুখ গুলোর কাছে নিজে সতী সেজে থাকাটা সত্যি স্বার্থপরের মতন লাগছিল । আমি সত্যি বলছি আমি বাধ্য হয়ে ওই লাইলে নামলাম । আমাদের দেশের অবস্তা সত্যি ভালো না । খাদ্য নেই,বাসস্থান নেই,নেই কোন সুরক্ষা । এখানে রোজ কোন না কোন মেয়ে কে বলি হতে হচ্ছে । কি আর করা যাবে এক দল বন্দুক ধারি দের কাছে যে আমরা বড়ো অসহায় । সারা পৃথিবীর মানুষ ও সব দেখে নির্বাক । আমরা কি করতে পারি । আমার আব্বু ছিলেন একজন নেক মুসলমান, কিন্তু আজ আমাদের এই পরিণতি । হে আল্লা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আমাদের অবস্থা, না তুমিও তো আজকাল বন্দুকধারীদের হাথে বন্দি ।
Comments
Post a Comment