শ্রীমদভগবদ্গীতা র প্রথম অধ্যায়ের অর্থ - দেবশ্রী চক্রবর্তী
শ্রীমদভগবদ্গীতা র প্রথম অধ্যায়ের অর্থ
দেবশ্রী চক্রবর্তী
শ্রীমদভগবদ্গীতা র প্রথম অধ্যায়ের ৪৬ নম্বর শ্লোকটি আমার কাছে অমৃতের সমান ।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপানয়ঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ।। ৪৬ ।।
এর অর্থ, অর্জুন বলছেন, অস্ত্র ধারণ করে ধৃতরাষ্ট্রর পক্ষের লোকেরা যদি অস্ত্ররহিত এবং যুন্ধ বিমুখ অবস্থায় আমাকে বধ করে ,তবে তা আমার কাছে অত্যন্ত হিতকর হবে । অর্জুন যুন্ধক্ষেত্রে নিজের আত্মীয় স্বজনদের বিপরীত পক্ষে দেখে গাণ্ডিব এবং তীর রেখে বসে পরেন । তিনি বলেন আমি নিজে যদি যুন্ধ থেকে বিরত হই, তাহলে দুর্যোধনরাও যুদ্ধ থেকে বিরত হবেন । অর্জুন বলছেন এই সময় তাঁকে ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে যদি কেউ হত্যা করে ,তা হলে এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না । নিজের গুরুজনদের হত্যা করার যে সিদ্ধান্ত সে গ্রহণ করেছে সেই পাপ থেকে সে মুক্তি পাবে, আর যুদ্ধ না হলে তার বংশের নাশ হবে না ।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি মানুষ যখন নিজের জন্য কোন কিছু বর্ণনা করে, তখন তার প্রভাব তার ওপর পড়ে । অর্জুন প্রথম অধ্যায়ের ২৮ তম শ্লোক থেকে যখন শোকাবিষ্ট হয়ে বলতে আরম্ভ করেন তখনো তিনি ততটা শোকমগ্ন ছিলেন না, যতটা এখন । ভগবান অর্জুনকে আগে তার দুঃখের কথা বলার সুযোগ দিলেন, অর্জুনের সব দুঃখ বেরিয়ে গেলে ভগবান বললে তখন তার কানে কথা গুলো ঠিক ঠাক ঢুকবে । প্রথম অধ্যায়ে অর্জুন যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা আমাদের কাছে গ্রহণ যোগ্য বলে মনে হয়, কিন্তু ভগবান যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা আমাদের কাছে গ্রহণ যোগ্য বলে মনে হয় না । এর কারণ মানুষ যে পরিস্থিতিতে থাকে সেই পরিস্থিতির কথাকেই তার ঠিক বলে মনে হয় । তার থেকে উচ্চ শ্রেণীর কথা সে অনুধাবন করতে পারে না । অর্জুনের মধ্যে স্বজন মোহ ছিল, সেই মোহে আবিষ্ট হয়ে সে এই কথা গুলো বলছিল , কিন্তু ভগবানের দৃষ্টিতে জীবের কল্যাণ কি করে হবে সে দিক তিনি বুঝতে পারেন নি ।
প্রকৃত পক্ষে ভগবান অর্জুনকে দিয়ে যুদ্ধ করান নি, বরং তার কর্তব্য জ্ঞান করিয়েছিলেন । অর্জুন নিজেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলে এবং ভগবানকে আহ্বান করেছিলেন । তার পড় তিনি নিজের কাজকে পাপ বলে মনে করে যুদ্ধ থেকে বিরত হন এবং কর্তব্য চ্যুত হন । ভগবান বলছেন মানুষ কোন কাজে যখন বড়টি হন তা মাঝ পথে থামিয়ে দেওয়া মানে কর্তব্য চ্যুত হওয়া ।
কোন এক ব্যক্তি বদরিনাথ যাচ্ছিলেন, পথ ভুলে তিনি আবার আগের যায়গায় ফিরে আসতে থাকেন, পথে একজন অপরিচিত তাঁকে বদরিনাথে ঠিক পথ বলে দেন, কিন্তু এই অপরিচিত লোকতই কিন্তু তাঁকে বদরিনাথ পাঠাননি , তিনি তাঁকে ঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র, বদরিনাথ যাবার সিদ্ধান্ত সেই লোকটির নিজের ছিলো । তেমনি ভগবান অর্জুনকে নিজ কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান করিয়েছিলেন, যুদ্ধ করান নি ।
প্রকৃত পক্ষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবসাম্ভাবিক ছিলো , কারণ সবার অয়ু শেষ হয়ে এসেছিল । ভগবান বিশ্বরূপ দর্শন করার সময় বলেছিলেন আমি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কাল এবং সকলের সংহার করার জন্য এখানে এসেছি । সুতরাং তুমি যুদ্ধ না করলেও তোমার বিপক্ষের যোদ্ধারা জীবিত থাকবে না । অর্জুন যদি এই সংহারে অংশ না নিত, তাও এই যুদ্ধ হত । অর্জুন না করলে পঞ্চপাণ্ডবের অন্য ভাই রা করত, ভীম কৌরবদের ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে পিছ পা হতেন না, দ্রৌপদি এমন কথাও বলেছিলেন যে “ আমার পতিরা পিছিয়ে এলে আমার পিতা,ভাই, আমার পঞ্চ পুত্র এবং অভিমুন্য এই যুদ্ধ করবে ।
গীতার প্রথম অধ্যায় থেকে আমরা যা শিক্ষা পাই তার অন্যতম হল যা হবার তা হবেই, তুমি না করলে অন্য কারুর মাধ্যমে তা হবে, আমরা নিমিত্য মাত্র, অনেকটা দাবার গুটির মতন, আমাদের চার পাশে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা কারুর কোন উপকার করলে ১০ বার শোনান যে তার কাজটা করেছেন, তিনি না করলে এই কাজ উদ্ধার হত না । তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলব, গীতা পরুন, তাহলে বুঝবেন আপনি না করলেও সেই কাজ অন্য কারুর মাধ্যমেই হত ।
ওম…। তৎ …। সৎ …।।
Comments
Post a Comment