নিজামের দেশের নারী শক্তি
নিজামের দেশের নারী শক্তি
দেবশ্রী চক্রবর্তী
২৫।৭।২০১৬ আমাদের রাজ্য থেকে প্রশাসকদের একটি দলকে অন্ধ্রপ্রদেশে ট্রেনিং এর জন্য পাঠান হয়ে ছিলো । সেই দলে আমার স্বামী অমর্ত্য চক্রবর্তীও ছিলো । ওনাদের হায়দ্রাবাদ এয়ারপোর্ট থেকে ৪ ঘণ্টা দূরে কুরনুল নামে একটি জেলা শহরে নিয়ে যাওয়া হয় । জেলা শহর হলেও কুরনুল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের যে কোন জেলা শহরকে টেক্কা দেবার মতন ক্ষমতা রাখে । যে দিন ওরা পৌঁছায় সেই দিন সন্ধ্যায় ওদের সম্মানে একটি অনুষ্ঠান রাখা হয় । সেই সময় অমর্ত্য আমাকে মোবাইলে ফোন করে মোবাইলটা খুলে রাখে । আমি শুনতে পাই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদ থেকে ৪ ঘণ্টা দূরে এক জেলা শহরে অন্ধ্রের ছেলে মেয়ে রা গান গাইছে “ ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা “ । প্রত্যেকের উচ্চারণ খুব স্পষ্ট এবং সুন্দর সুরে তালে তাঁরা গানটা গাইছেন । সেই মুহূর্তে একজন বাঙ্গালি হিসেবে মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল ।
আমি কিন্তু এখানে কোন ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসি নি । আমি আজ এমন কিছু মানুষের কথা লিখব যা ফেয়ারি টেলের স্নোহোয়াইটদের কাহিনীকে হার মানিয়ে দেয় । পরের দিন খুব সকালে অমর্ত্যরা জেলা শহর থেকে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে । চারিদিকে পাহাড় , আম বাগান,কলা বাগান , সবজি বাগান তার মাঝে মার্বেল বসান সুন্দর সুন্দর বাড়ি । কিছু দূরে যাবার পর অমর্ত্যদের মহা সংঘে নিয়ে যাওয়া হয় । সংঘে গিয়ে তাঁরা বিজয়া ভারতী নামে এক প্রবীণ মহিলার সাথে দেখা করেন । বিজয়া ভারতির পরিচয় দেবার আগে অঞ্চলের পরিচয়টা একবার দি । এই অঞ্চলের মানুষরা এক সময় দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতেন । আমরা জানি দাক্ষিণাত্যে কৃষ্ণ মৃত্তিকাতে কার্পাস চাষ খুব ভালো হয় । কিন্তু এই কালো মাটির ওপরে দুই স্তর পাথরে ঢাকা ছিলো । মানুষজন গ্রাম ছেড়ে হায়দ্রাবাদ চলে যেতেন কাজের সন্ধানে । মানুষের দুঃখ দুর্দশার শেষ ছিলো না । সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশ এর একজন মহিলা প্রশাসকের পোস্টিং হয় এখানে । তিনি হলেন বিজয়া ভারতী । তিনি এখানকার মানুষদের দুঃখ কি ভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবনা চিন্তা করলেন। তার পর এক দিন মেয়েদের বললেন তোমরা প্রত্যেক দিন এক টাকা করে জমাতে শুরু করো । প্রত্যেকে তাই করল । সেই টাকা দিয়ে কিছু বছর পর শুরু হলো মহা সংঘের কাজ । কাজটা কিন্তু সহজ ছিলো না , মেয়েরা নিজেরা স্বাবলম্বী হতে শুরু করল , তা দেখে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ প্রতিবাদ জানাল, স্ত্রীদের ওপর শুরু হলো অমানুষিক অত্যাচার । তা কিন্তু নারী শক্তিকে আটকে রাখতে পারল না । গ্রামের দুই জমিদার ছিলো , তাঁরা দেখল দরিদ্র পরিবার গুলোর হাতে অর্থ চলে আসছে, তাহলে মহাজনি কারবার তাঁরা চালাতে পারবে না । তার ওপর সবার হাতে অর্থ এসে গেলে দরিদ্র ঘরের ছেলেদের তাঁরা গুণ্ডাও বানাতে পারবে না, সেই সব দিক ভেবে তারা প্রতিবাদ করল । বিজয়া ভারতী তথা নারী শক্তি কিন্তু হাড় মানলেন না, তারা কাজ চালিয়ে গেলেন । আজ ২০১৬ শালে কুরনুল জেলার মেয়েদের মাথা পিছু বাৎসরিক ইনকাম ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা । কোন গাল গল্প না । এই বাস্তব দেখে আমাদের রাজ্যের প্রশাসকদেরও চোখ মাথায় উঠে গেছিল ।
এবার আমি দু জন নারীর কথা তুলে ধরছি , তাঁদের উত্থানের গল্প শুনলে আপনারা পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন । একজন মুসলিম মহিলার কথা বলি প্রথমে । তার ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল । বিয়ে হবার পর তিনি ৪ সন্তানের জননী হন । কিছু বছর পর তার শাশুড়ি তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে দেয় । সেই ভদ্রমহিলা মহাসংঘে এসে নাম লেখান । প্রথমে সে কিছুটাকা ঋণ হিসাবে পান এবং তা দিয়ে একটা ছোট জমি কিনে কিছু আম গাছ লাগান । প্রথমেই বলেছি জমিতে পাথরের ভাগ বেশি, মানুষ সস্তায় জমি বিক্রি করে চলে যেত এই অঞ্চল থেকে । মহিলা সস্তায় জমিটা পেয়ে যান । তার পর নিজে কুড়ুল দিয়ে জমির ওপরের দুই স্তরের পাথর সরিয়ে ফেলেন । তারপর যে মাটি বেরিয়ে আসে তা এক কথায় ভগবানের মাটি । যে গাছি লাগা না, ফলন হবে ভগবানের দানের মতন । এই ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না । মহিলা আম গাছ লাগিয়ে নানা জায়গাতে ঠিকে কাজ করতে লাগেন এবং প্রতি দিন ১ টাকা করে জমাতে থাকেন । এই ভাবে ৪ বছর পর মহিলা নিজের গাছের আম বিক্রি করে ৬০০০ টাকা পান । সালটা কিন্তু ২০০৬ । তারপর ভদ্রমহিলা ৬০০০ টাকা থেকে কিছুটাকা দিয়ে মহাস্নগের ঋণ শোধ করেন এবং ১ টাকা করে যে ৪ বছর ধরে জমিয়েছেন তার সবটা দিয়ে আরও কিছু জমি কেনেন এবং তাতে আরও আম গাছ লাগান । তার জন্য মহা সঙ্গ তাঁকে আরও কিছুটাকা ঋণ দেন । আজ এই মহিলার বাৎসরিক ইনকাম ৮ লাখ টাকা । নিজের চার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন পণ নেন নি ।প্রত্যেক বউকে গয়না দিয়েছেন । কিন্তু মেয়ের বিয়েতে পণ দিয়ে ৬ লাখ টাকা খরচ করারয়েছেন ।
এবার এক হিন্দু মহিলার কথা বলি । তার কাজ ছিলো গ্রামের মহাজনের আম গাছে জল দেওয়া । এতে তিনি প্রতিদিন ৫ টাকা করে পেতেন । মহাজন আবার লাঠি ঢুকিয়ে গাছের গোঁড়ায় পরীক্ষা করতেন জল ঠিক মতন দেওয়া হয়েছে নাকি । সেই মতন ভদ্র মহিলা টাকা পেতেন । এক দিন তিনি মহা সংঘে নাম লেখান । প্রতি দিন এক টাকা করে জমাতে থাকেন এবং মহা সংঘের থেকে টাকা ধর্ম নিয়ে আম গাছ লাগান । এই ভাবে আজ মহিলার জমির মূলয় ৪৩ লাখ টাকা । তিনি শুরু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে । বাৎসরিক রোজগার ৭ লাখ টাকা । কিন্তু তিনি দুঃখ করে বলেছেন খেতে না পেয়ে তার স্বামী তিন ছেলে মারা গেছে । আজ তার এত অর্থ, যা আছে সব ছোট ছেলের ।
মহা সংঘ থেকে প্রতি বছর ভারতের সব রাজ্যে ট্রেনিং দিতে যায় মেয়েরা । এঁরা ভারতের সব ভাষাই প্রায় জানে । কেউ অনর্গল বাংলাতে কথা বলছে, কেউ গুজরাতি তে । আমাদের নন্দীগ্রামে এখনও বেশ কিছু মেয়ে আছে । অনেকে আগে ট্রেনিং দিতে এসেছিলেন, তারা অমর্ত্যকে দেখেই চিনতে পেরেছেন ।
মহা সংঘ নিজের টাকাতে ৮ কোটি টাকার স্কুল করেছে । এখানে গ্রামের বাচ্চারা বিনা মূলয়ে পড়াশুনা করে । কোন বাইরের লেবার না, নিজেরা এই স্কুল তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছেন । আসাম থেকে সেগুণ কাঠ আনিয়ে নিজেরা ডেস্ক ,চেয়ার, টেবিল তৈরি করেছেন । স্কুল থেকে আমার ফ্রুটিকে খুব সুন্দর একটা ব্যাগ দিয়েছেন ওনারা, অমর্ত্যকে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেওয়া ডাইরি দিয়েছেন । এই স্কুলে একটা স্পেশাল ক্লাস করানো হয় দারিদ্র দূর করা যায় কি ভাবে । মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু নিজে সব সময় দের সাহায্য করেন । সব থেকে মজার ব্যাপার কি জানেন এখানে পঞ্চায়েত গ্রুপের মেয়েদের কাছ থেকে গ্রুপের মেয়েদের তৈরি বাড়ি ভাঁড়া নেন । চন্দ্রবাবু নাইডু একশ দিনের কাজ,ইন্দিরা আবাসন, পেনসান এর মতন অনেক কিছু পঞ্চায়েতের হাতে রাখেন নি , তাই দুর্নীতি কম হয় । মহাসংঘ থেকে মেয়েরা তাঁদের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পান । সংঘ থেকে টাকা ধার নিয়ে স্থানীয় মেয়েরা তাঁদের স্বামী এবং ছেলে দের অটো , টেম্পো এসব ও কিনে দিয়েছে এবং মাসে মাসে সেই টাকা শোধ ও করে দেন । আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই সব অঞ্চলে কন্যাশ্রীর মতন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল । এখানে প্রতি পরিবারের মেয়েদের নাম এ বিনা মূলয়ে আমগাছ এবং জমি দান করা হয়, সেই আম গাছে লিস দিয়ে প্রতি মেয়ে পিছু ৭০ হাজার টাকা মতন পরিবারের লোকেরা আয় করে । অর্থ উপার্জনের পথ আছে, তোমাকে খেটে অর্থ নিয়ে যেতে হবে । মহা সংঘের বব্যাংকের বর্তমান পুঁজি ১৬ কোটি টাকা । যে ম্যানেজার সেও একজন নারী । তার মাইনে ৫০০০ টাকা । তাঁকে যখন বলা হয় এত অল্প বেতনে আপনাকে এত খাটতে হয় । সে বলে আমারই তো ব্যাঙ্ক খাটনির আর কি আছে । এতো গেলো কুন্নুর জেলার দৃশ্য, সারা আন্ধ্রপ্রদেশের কিন্তু এই এক চিত্র, গ্রুপের মেয়েরা এই ভাবে কাজ করে দরিদ্র দূর করছে । অমর্ত্য বলছিল ওর সব থেকে ভালো লেগেছে হিন্দু মুসলিম সহাবস্থান । সবাই এক জায়গাতে বসবাস করে । আলাদা পল্লী নেই । মহা সংঘের যেখানে ক্লাস হয় চার দিকে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, সেখানে মুসলিমরা এসে প্রণাম করছে, তারা সেখানে বসে ক্লাস ও নিচ্ছে । কেরল নাকি অন্ধ্রের থেকে এগিয়ে গেছে । ওখানে নাকি মেয়েরা গ্রুপের কাজ করে বাস কিনেছে । প্রাইভেট বাস ভাঁড়া দেয় । পশ্চিম বঙ্গে যে কবে এই দিন আসবে, আমি তো স্বম্ন দেখছি ।
লেখা শেষ করার আগে একটা কথা বলতে চাই, অন্ধ্রপ্রদেশে যা সম্ভব হয়েছে তা পশ্চিম প্নগেও সম্ভব । কিন্তু এখান কার বেশির ভাগ গ্রুপের মেয়েরা টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয় না । কিছু একটা ভালো কাজ করতে যাও পার্টির কিছু গুণ্ডা বলবে আমাদের ভাগ চাই, না হলে কাজ করতে দেওয়া হবে না । এই মহা সঙ্গের স্কুলটাই যদি এখানে কোন গ্রামে তৈরি করার চেষ্টা করা হতো, তাহলে ৮ কোটির জায়গাতে ১৮ কোটি লাগতো । পার্টির নেতা বলত আমার ভাই বানাবে …। আরও অনেক গল্প আছে । সেই সব থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই এখানেও সম্ভব, না হলে আমলাদের ট্রেং এ পাঠিয়ে কোন লাভ নেই …।
Comments
Post a Comment