সরস্বতী নদী ২

সরস্বতী নদী ২ 

দেবশ্রী চক্রবর্তী 

ঋকবেদের পয়তাল্লিশটি স্তোত্রে বাহাত্তরবার এবং তিনটি স্তোত্র সম্পূর্ন ভাবে সরস্বতী নদীকে 
উৎসর্গ করা হয়েছে । ঋকবেদে এই নদীকে দুটি বিশেষ নামে আহ্বান করা হয়েছে ইলা এবং ভারতী । বেদ এবং পুরানে এই নদীর উচ্ছল জল্প্রবাহের এবং নদীর দুই তীরের শস্যশ্যামলা ভূমির বর্ননা করা হয়েছে । প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন বর্ননায় এই নদীর উল্লেখ আমরা পাই । ঋকবেদের রচয়িতারা সরস্বতী নদী ধারে বসে এই নদীর উচ্ছল কলকালনীর ধ্বনীর ছন্দের ঋকবেদের স্তত্র রচনা করেছিলেন । নদীর এই ধ্বনী দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে যেহেতু ঋকবেদ রচিত হয়েছিল, তাই এই নদীকে বাকদেবী অথবা ভাষ দেবী বলা হয় । ব্রম্ভার এই কন্যার বর্ননা বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও পাওয়া যায় । ঋকবেদে সরস্বতীর সাত বোনের উল্লেখ আছে । বেদের একটি স্তোত্রে লেখা আছে সরস্বতী তার দুই বোন যমুনা আর সুতলেজ নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে । এই তথ্য অনুযায়ি পরবর্তী সময়ে বৃটিশ রাজত্বে গবেষনা করে সত্যি এই দুই নদীর মাঝে শুকনো নদী খাতের সন্ধান পাওয়া গেছে । স্বরস্বতী নদীর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নানা রকম কারন বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে । আমি মহাভারত থেকে একটি গল্প তুলে ধরছি, যাতে বর্ননা দেওয়া আছে যে , উতাথ্য নামে একজন ঋষি ছিলেন । তার স্ত্রীকে বরুন দেব অপহরন করলে তিনি তার স্ত্রীকে খুজে বার করার জন্য সরস্বতীকে সুকিয়ে যেতে বলেন । এবং এই সময় এই নদী রাজস্থানের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে । সার মানে হ্রদ । রাজস্থানে বহু জায়গার নাম সার দিয়ে । এর থেকে বোঝা যায় যে এই সব অঞ্চল গুলোতে কোন এক সময়ে জলের প্রবাহ ছিল । রাজস্থানের পুস্করের ওপর দিয়ে নাকি এক সময় সরস্বতী নদী প্রবাহিত হত । 

মহাকবি কালিদাশের মেঘদূতে মেঘের যে প্রবাহ, রূপ এবং দিক পরিবর্তনের উল্লেখ আছে তা অদ্ভূতভাবে সরস্বতী নদীর যাত্রাপথকে উল্লেখ করে । বরাহমিহিরের বৃহত সঙ্ঘিতায় এই নদীর ভৌগলিক মানচিত্রের উল্লেখ আমরা পাই । বানভট্টের হর্ষচরিতে লেখা আছে সপ্তম শতকের মধ্যভাগে হর্ষবর্ধন নামে একরাজা রাজত্ব করতেন উত্তর ভারতে । এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে হর্ষবর্ধনের পিতার মৃত্যু হলে তিনি সস্বতী নদীতে পিতার অস্তি বিসর্জন দেন এবং সেখানে স্নান করেন । প্রতিহার রাজ মিহির ভোজের একটি প্রসস্তি প্রিথুডাকা কোন এক সময়ে এই সরস্বতী নদীর তীরে লেখা হয়েছিল । শুধু তাই না মুঘল যুগের রেভিনিউ রিপোর্ট এবং তারিখ ই মুবারক শাহি তে এই নদীর প্রবাহের উল্লেখ আমরা পাই । 

কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জামানায় সরস্বতী নদীর গতিপথ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি তৈরি হয়। কিন্তু, ইউপিএ সরকারের জামানায় এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসতেই ফের এই প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ শুরু হয়। প্রাচীন মরে যাওয়া সরস্বতী নদীর গতিপথ খুঁজে পাওয়াটা সহজ ছিল না। ইসরো-র সাহায্যে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে হরিয়ানার তিন জেলায় সরস্বতী নদীর সম্ভাব্য গতিপথকে চিহ্নত করা হয়। এর পরেই সেখানে ড্রেজিং শুরু হয়। আদি বদরীতে মাটি খুঁড়তেই গলগল করে জল বেরিয়ে আসতে থাকে। আপাতত ঠিক হয়েছে কুরুক্ষেত্র, যমুনানগর এবং কৈথাল জেলায় সরস্বতী নদীর যে গতিপথ উপগ্রহের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাকে পুনরুজ্জীবীত করা হবে। এর জন্য ৩০ জুলাই সরস্বতী নদীর ওই গতিপথে জল ঢোকাবে হরিয়ানা সরকার। 

আশা করা হচ্ছে, বর্ষা থাকায় এই জল আপাতত শুকোবে না। তবে, দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে দাদুপুর ফিডার ক্যানেলে একটি বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকে জল নিয়ে আসা হবে এই সরস্বতী নদীতে। 
আইআইটি-র শিক্ষক-ছাত্র থেকে শুরু করে ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনে কাজ করছে। পরবর্তীকালে পুনর্জন্ম পাওয়া সরস্বতী নদীর তীর ধরে সৌন্দর্যায়নেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। 
যদিও, ৪ হাজার বছর আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীরর পুনরুজ্জীবন প্রকল্পকে মোদী সরকার যেভাবে মান্যতা দিচ্ছে, তাতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে গঙ্গা-যমুনা এবং সরস্বতী নদীকে যেহেতু হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিধারা হিসাবে ধরা হয়, তাই হিন্দুত্বের জিগিরকে জাগিয়ে তুলতেই কি সরস্বতী নদীর এই পুনরুজ্জীবন প্রকল্প— এই নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কারণ, খরা প্রবণতার মোকাবিলা বা মরুরাজ্য রাজস্থানের কোণে কোণে জল পৌঁছে দেওয়া যেখানে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেখানে প্রাকৃতিক কারণে হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবন প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে কতটা সহায়ক হবে, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। 

রাজস্থান এবং গুজরাটের কচ্ছের রান অঞ্চলে খনন কার্যের ফলে মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রবল জলধারা । আমি দু মাস আগে জয়শালমির গেছিলাম । সেখানে দেখে এসেছি একশ দিনের কাজের মাধ্যমে সরস্বতীর গতিপথে খননকার্য চালানর ফলে সেখানে কি ভয়ঙ্কর স্রোত বয়ে চলেছে । রাজস্থানের ৫০ কিলোমিটার খননকার্য চালানোর ফলে জলধারা দেখা নিয়েছে । সেখানে মানুষ চাষাবাদ শুরু করেছে । পাঞ্জাব থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞরা এসে সেখানে নিত্য শিক্ষা দিচ্ছেন । মরুভূমির মাঝে আমি নিজের চোখে চাষ হতে দেখেছি । আর হয় তো ২০ বছর পর থর মরুভূমির অস্তিত্ব থাকবে না । হরিয়ানা, পাঞ্জাব,রাজস্থান এবং গুজরাটে নদীর মাটি নিয়ে কার্বোন টেস্ট করে ধরা পরেছে যে এই নদী দশ হাজার বছর পুরোন এই নদী । ভাবা এটোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ইসরোর মিলিত উদ্দোগে স্যাটেলাইট ইমেজ এর মাধ্যমে এই অনুসন্ধান চলছে । যা প্রথম শুরু হয় ১৯৭১ সালে আমেরিকার স্যাটেলাইট ইমেজ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভারতবর্ষে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে ধরা পরে এই নদীর অন্তঃশলীলা প্রবাহ । 

গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী— এই তিন নদীকে হিন্দুদের পবিত্র ধারা বলে মনে করা হয়। এলাহাবাদের সঙ্গমে গঙ্গা ও যমুনার দেখা মিললেও, সরস্বতীকে দেখা যায় না। মনে করা হয়, অদৃশ্য হয়েও সরস্বতী নদী এই সঙ্গমে এসে মিশেছে। যদিও, ইতিহাস বলছে ৪ হাজার বছর আগে মৃত্যু হয়েছে সরস্বতী নদীর।৪ হাজার বছর আগে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যু হয়েছিল সরস্বতী নদীর। বেদ-এ এই নদীর উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে কোনওদিনই দেখা মেলেনি সরস্বতী নদীর। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে সরস্বতী নদীর ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। এই নদীর তীরে বসবাসকারীরা মূলত ছিলেন লিঙ্গোপাসক। তাই পরে এঁদের ‘হিন্দু ধর্মালম্বী’ বলেই গণ্য করা হয়েছে। মহাভারত-এও উল্লেখ মেলে এই সরস্বতী নদীর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধস্থলের কাছ দিয়েই নাকি প্রবাহিত ছিল সরস্বতী নদী। তবে, সরস্বতী নদীর উৎসস্থল নিয়ে আজও ধোঁয়াশা আছে। একদল ইতিহাসবিদদের দাবি, সিন্ধু নদ ছিল এর উৎস। কিন্তু, আবার একদল ইতিহাসবিদদের দাবি, বর্তমানে হরিয়ানার আদি বদরিতে নাকি এর উৎস। চার হাজার বছর আগে সরস্বতী নদী নাকি হরিয়ানার যমুনানগর জেলার ৪১টি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হত। এমনকী, কুরুক্ষেত্রও নাকি ছিল সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত। হর্ষবর্ধনের রাজধানী থানেশ্বরও নাকি ছিল সরস্বতী নদীর তীরবর্তী শহর। হরিয়ানা থেকে রাজস্থান হয়ে গুজরাটে নাকি শেষ হয়েছিল সরস্বতীর প্রবাহ। 

তিনি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী৷ তিনি আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির প্রতীক৷ আবার তিনিই হারিয়ে যাওয়া নদী৷ ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাসে এভাবেই মিলেমিশে আছেন সরস্বতী৷
সরস্বতী শব্দের মধ্যেই এই দু ধরনের অর্থের দেখা মেলে৷ প্রথমত, ‘স্ব’ অর্থাৎ আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির ‘সার’৷ তা থেকেই সরস্বতী৷  আবার ‘সরস বতী’ রূপেও সরস্বতী শব্দের ব্যাখ্যা করেন অনেকে৷ সরস্বতী তাই একাধারে নদী ও দেবী দুইই৷
ঋকবেদেই প্রথম সরস্বতী শব্দের উল্লেখ মেলে৷ গায়ত্রী ছন্দে বাঁধা সে সূক্তটি এরকম-
পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী। যজ্ঞং বষ্টু-ধিয়াবসুঃ।।
চোদয়িত্রী সূনৃতানাম্ চেতন্তী সুমতীনাম্। যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।

এখানে সরস্বতীকে অন্নদাত্রী, শিক্ষয়িত্রী, জ্ঞানদাত্রী ও জলদাত্রী হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে৷ অধুনা অবলুপ্ত বৈদিক নদী সরস্বতীর ধারণা আমরা এখান থেকেই পেয়ে যাই৷ বৈদিক সভ্যতার ভিত্তি ছিল এই নদীর জলরাশিই৷ কিন্তু কালক্রমে তা হারিয়ে যায়৷ বস্তুত সিন্ধু সভ্যতাও সরস্বতীর জলেই পুষ্ট হয়েছিল৷ আজ যে যমুনাকে আমরা দেখি, তা এককালে সরস্বতীরই উপনদী ছিল৷ আমরা স্মরণ করতে পারি, কৃষ্ণের দাদা বলরাম একবার যমুনাকে আকর্ষণ করেছিলেন৷ পৌরাণিক এ কাহিনীর ভিতর থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট৷ বড়সড় কোনও পরিবর্তনের জেরেই কারণেই রাজস্থানের কোনও গ্রামের কাছে হারিয়ে যায় সরস্বতীর পথ৷ তবে অন্তঃসলিলা হয়ে সরস্বতী আজও বয়ে চলে বলে অনেকের ধারণা৷ সরস্বতী নদী যে ছিল এ নিয়ে আজ আর কোনও সংশয় নেই৷ দীর্ঘ গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে৷






Comments

Popular Posts