সরস্বতী নদী , পর্ব ৩
সরস্বতী নদী , পর্ব ৩
দেবশ্রী চক্রবর্তী
আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয়ার বরফ গলার সাথে সাথে হিমালয়ের বরফ গলা শুরু হয় । দশ হাজা বছর আগে হিমালয়ের বরফ গলা শুরু হলে সেই বরফ গলা জল প্রবল স্রোতে নেমে আসে সমতলের দিকে । এই সময়েই সরস্বতী নদীর জন্ম হয়েছিল । আমাকে যদি টাইম মেশিনে বসিয়ে বলা হয় যে আমি কোন সময়ে যেতে চাই, আমি চোখ বন্ধ করে বলবো যে আমি আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে যেতে চাই । যখন হিমালয়ের জল গলে ক্ষর স্রোতা নদী ও ঝর্না নেমে আসছিল সমতলের দিকে , আমি সেই প্রবল স্রোতকে প্রনভরে দেখতে চাই ।
পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার পশ্চিম দিকে ভতিন্ডা এবং পাটিয়ালার মাঝা খান দিয়ে বেশ কিছু শুকনো নদী খাতের সন্ধান পাওয়া গেছে । যা আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে হনুমানগড়ে এসে একসঙ্গে ঘাগরে মিলিত হয়েছে । কোন এক সময়ে এই সব শুকনো নদী খাত দিয়ে সরস্বতী নদী প্রবাহিত হয়ে থর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের মরুপ্রদেশে মিলিত হত ।
নাসা এবং ইসরোর স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পরেছে, বর্তমান থর মরুভূমির মাঝখান দিয়ে এখনো অন্তশলিলা হয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী । কোন এক সময়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে এই নদী পাতালে প্রবেশ করেছিল । ১৯৫০ সালে ভারতীয় প্রত্নতত্ববীদ অমলানন্দ ঘোষ মহাশয় থর মরুভূমির বালিতে পলিমাটি পলিমাটির সাথে বেশ কিছু মৃত শামুখের খোলের সন্ধানও পেয়েছিলেন । এর থেকে প্রমানিত হয় যে কোন এক সময়ে এই অঞ্চলে নদী প্রবাহিত হত এবং এই সব প্রানীর অস্তিত্ব ছিল ।
বিখ্যাত ভারতীয় ভূতত্ববীদ কে এস বৈদ্য মহাশয় তার গবেষনায় লিখে গেছেন যে সরস্বতী কোন এক সময়ে ভারতের সব থেকে ক্ষরস্রোতা নদী ছিল । এবং এই নদীর তীব্র স্রোত চম্বলের কাছে ভাগ হয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে, যাকে অনেকে যমুনা বলে মনে করে । জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন প্রধান তথা বিখ্যাত ভূতত্ববীদ ভি এম কে পুরি সুইজারল্যান্ডের গ্ল্যাসিয়ার অরগ্যান্সের একটি আন্তর্জাতিক সভায় বক্তব্য রেখেছিলেন, ১৯৯৮ সালে তিনি এবং তার সহকর্মী বি সি বর্মা মারকান্ডা এবং বাট্টা উপত্যকার মাঝে প্রায় পনেরোশ অন্তঃশলিলা স্রোতের সন্ধান পেয়েছেন । তারা উল্লেখ করেছেন যে এই সব স্রোত গুলি শিবালিক থেকে নেমে এসেছে । প্রায় ৪০০০ থেকে ৫০০০ মিটার উচ্চতায় তারা এইসব স্রোতের জন্মস্থান খুজে পেয়েছেন । শিবালিক থেকে সরস্বতীর নদী উৎপত্তি হয়ে এই নদী মারকান্ডা এবং বাট্টা উপত্যকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছিল । পুরি এবং বৈদ্যর গবেষনা যদি সত্যি বলে এনে নিই, তাহলে এটা সত্যি যে হিমালয়ের বরফ গলা জলের প্রোবল স্রোত পশ্চিম ভারতে সরস্বতী নদী নামে প্রবাহিত হয়েছিল । এবং এই নদীর থেকে বেশ কিছু স্রোত বেরিয়ে বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছিল । রাজস্থানের জয়শালমির জেলার মরুভূমিতে খনন কার্য চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মরুভূমির ভেতর থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে আসছে প্রবল জল স্রোত । কোন কোন জায়গায় মরুভূমির মাঝে খুজে পাওয়া যায় মিষ্টি জলের কূয়ো । ইসরো এবং নাসার স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পরেছে , জয়শালমিরের থর মরুভূমির ওপর দিয়ে অন্তঃশলীলা হয়ে বয়ে যাচ্ছে সরস্বতী নদী । কিশানগড় থেকে তানোট সহ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পারের বেশ কিছু অঞ্চল এর ওপর এই নদীর স্যাটেলাইট চিত্র ধরা পরেছে ।
১৯৯৫ সালে ভাবা এটমিক এনার্জির দুই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী , ডঃ কুলকার্নি এবং ডঃ রাও রাজস্থানের থর মরুভূমির বেশ কিছু শুকনো নদী খাত থেকে বালি সংগ্রহ করে রেডিও কার্বোন পরীক্ষা করে জানত পেরেছিলেন যে আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে নদী বয়ে যেত ।
হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রতিটি নগর এবং বন্দর এর ওপর দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী । কিছুদিন আগে ইরানে প্রাপ্ত সিন্ধু সভ্যতার একটি শিলমোহরে সরস্বতী নদীর বর্ননা পাওয়া যায় । উত্তরে কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্থান হয়ে কচ্ছের রান ধরে গুজরাটে যে যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে এই নদী বয়ে গেছিল, সেই সেই অঞ্চলে এই সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল । বালুচিস্তানের বোলান নদীর তীরে কৃষি ভিত্তিক নদীমাতৃক যে সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গেছে, তাকে প্রাক হরপ্পা সভ্যতা বলে ধরা হয়ছে । এবং মনে করা হয়ে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত শুকনো নদী খাদে বয়ে যেতো সরস্বতী । এই নদীর তীরে কৃষিভিত্তিক নদীকেন্দ্রীক হরপ্পা সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল । পরে ভয়ঙ্কর ভূমি কম্পের ফলে নদী ভূগর্ভে অন্তর্ধান হলে এই সভ্যতা নানা রকম পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় । কারো কারো মতে ভূ-পৃষ্ঠ ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় সিন্ধু অঞ্চলের মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের অনেকাংশে মরুভূমির প্রভাব পড়ায় ধীরে ধীরে মাটি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে এ সভ্যতা আর আগের মতো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। মর্টিমার হুইলারের মতে, সভ্যতার শুরুতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও বনাঞ্চলের যে চিত্র ছিলো তা শেষ দিকে ছিলো প্রায় অনুপস্থিত। এতে কৃষি-ব্যবস্থার পাশাপাশি বন্দর হিসেবে মহেঞ্জোদারো নগরীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। ড. হুইলার মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার পতনের বেশ আগে থেকেই এর পতনের আভাস পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালের মহেঞ্জোদারো নগরীকে তিনি পূর্বের মহেঞ্জোদারোর ‘ছায়ামাত্র’ বলে অভিহিত করেন।এই সভ্যতার ধ্বংষের পেছনে অনেক ঐতিহাসিক প্রবল ভূমিকম্পের ফলে সরস্বতী নদীর হারিয়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন ।
ভৌগোলিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে কি সরস্বতী নদী শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ?অনুমান করা যায় যে বৈদিক সরস্বতী (আঞ্চলিক নাম সরসুতী) হরিয়ানার থানেশ্বর অঞ্চলে প্রবাহিত। ঋগ্বেদে (VIII, 36.6 সূক্ত) বলা হয়েছে সপ্তথি সরস্বতী নদীগুলির মাতা (সিন্ধুমাতা) একসাথে দুগ্ধ ও স্রোতস্বিনীদের নিয়ে বিপুল গর্জনে তীব্র স্রোতে প্রভূত জলধারায় স্ফীত হয়ে প্রবাহিত।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি,অন্যটি নদী। সরস্ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের।আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা।শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী।ঋগ্বেদেএবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়।বেদেরমন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা।ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত,জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত।কবি বিহারীলাল চক্রবতী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন।রামায়ণরচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন,সে সময়জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।ঋগ্বেদেইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ওঅশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনো-বাইন্দ্রের চিকিৎসক।শুক্লযজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রুপে রুদ্র অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা প্রবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল।‘কথা সরিৎসাগর’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন,পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন।নিরুক্তকারযাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সরশব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমিরঅন্যতম নদীরূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতির্ত ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতীসিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতেএদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে।‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ – অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়তো শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন। সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী। তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা।দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায়।প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন,এই নদীর তীরে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তার অধিবাসীরা মেষ এবং শূকর পালন করতেন এবং সরস্বতীর নির্মলধারায় হাসেরা খেলা করত । হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন।গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে।পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই।মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী।শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতীকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল।শুধুবৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুরপর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতেঅবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণা বৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান।ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি।সরস্বতীও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত।মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেওকয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ওনাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতীঅদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়।তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর,মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপস্থানই বিনশন। লাট্যায়ণেরশ্রৌত সূত্র মতে, “সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত,তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশকেউ দেখতে পায় না,তাকেই বিনশন বলা হয়”।অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে।মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে।নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে।অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী।সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গাসরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারূপেগুপ্তভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলারত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ওপবিত্র বিশ্বাস। সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে।তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয়।হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হল, শুরু হল ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদসমূহ।
যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাদের প্রথম দেবতা। কিন্তু আমরা তো জানি, শুধু বাবাতে আমাদের মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্যজাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন আমাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্ শব্দের অর্থ জল।
শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধানা এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্যা ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি,অন্যটি নদী। সরস্ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের।আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা।শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী।ঋগ্বেদেএবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়।বেদেরমন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরূপা।ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত,জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত।কবি বিহারীলাল চক্রবতী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন।রামায়ণরচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন,সে সময়জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।ঋগ্বেদেইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ওঅশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনো-বাইন্দ্রের চিকিৎসক।শুক্লযজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রুপে রুদ্র অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা প্রবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল।‘কথা সরিৎসাগর’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন,পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন।নিরুক্তকারযাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সরশব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমিরঅন্যতম নদীরূপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতির্ত ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতীসিন্দু ও তার পাঁচটি উপনদী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতেএদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে।‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ – অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে। সম্ভবত সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই হয়তো শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী বিদ্যার দেবী হয়ে উঠেছেন। সরস্বতীর আর-এক নাম ভারতী। তিনি ‘ব্রাহ্মণ’-এ বাক্ নামে পরিচিতা।দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সরস্বতীকে ব্রহ্মার মানসকন্যা হিসাবে কল্পনা করা হয়।সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও মেষ আর বরাহকে পাওয়া যায়।প্রত্নতাত্ত্বিক এন এস ভট্টসারি একটি লেখায় বলেছেন,এই নদীর তীরে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তার অধিবাসীরা মেষ এবং শূকর পালন করতেন এবং সরস্বতীর নির্মলধারায় হাসেরা খেলা করত । হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন।গান্ধারের পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে।পাথরের একটি ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, এর সঙ্গে হিন্দুদের সরস্বতীর কোনো পার্থক্য নেই।মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের উপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদিত ছিল। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ১৬ জন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতম হলেন সরস্বতী।শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর জৈন সম্প্রদায় উভয়েই সরস্বতীকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে গৃহীত একজন প্রধান দেবীরূপে স্থান হয়ে গেল।শুধুবৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুরপর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতেঅবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণা বৃক্ষের নিকটে, তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান।ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি।সরস্বতীও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত।মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেওকয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা হল চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ওনাগোদ্ভেদ। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতীঅদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়।তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর,মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিমপ্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপস্থানই বিনশন। লাট্যায়ণেরশ্রৌত সূত্র মতে, “সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিত,তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশকেউ দেখতে পায় না,তাকেই বিনশন বলা হয়”।অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, খ্রিস্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে।মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে।নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে।অনেকেই বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী।সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী।নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গাসরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারূপেগুপ্তভাবে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে সরস্বতীর সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলারত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ওপবিত্র বিশ্বাস। সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা নানা বিশ্লেষণ প্রচলিত আছে।তাই সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা, তবে অসম্ভব নয়।হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হল, শুরু হল ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদসমূহ।
যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাদের প্রথম দেবতা। কিন্তু আমরা তো জানি, শুধু বাবাতে আমাদের মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্যজাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন আমাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্ শব্দের অর্থ জল।
শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধানা এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্যা ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে। একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী কুব্জা ছিলেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, এই বর্ণনা একই সঙ্গে সূর্যতেজোময়ী সরস্বতী এবং নদীরূপা সরস্বতীর ইঙ্গিত দেয়। আলো যেমন এঁকেবেঁকে যেতে পারে, তেমনই নদীর স্রোতও আঁকাবাঁকাভাবেই চলে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, আকাশের ছায়াপথ নামক অংশটিই হল দিব্য বা জ্যোতিরূপা সরস্বতী।
দেবী সরস্বতীকে আমরা জানি শুধুমাত্র বিদ্যাদায়িনী হিসেবে। কিন্তু বৈদিক যুগে আরো অনেক গুণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। 'প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী' -- তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
তিনি দানবদলনী। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে 'সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্।'
তিনি দানবদলনী। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে 'সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্।'
সূর্যের তেজোরূপা হবার দরুণ সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তাঁকেই দান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় যখন যে দেবতা প্রাধান্য পেয়েছেন, তখন তাঁর গুণগুলিও সরস্বতীতে আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই তিনি কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও বটে। এই কারণে তাঁকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমা্রদের স্ত্রী হিসেবেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্ত্রী বলে পরিচিতা হয়েছেন। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেন। জ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী। ত্রিদেব ধারণাতে বিষ্ণু ছিলেন প্রধান দেবতা, তাই প্রধানা দেবীকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই ধরা হয়েছে।
Comments
Post a Comment